এম.কে বড়ুয়া, তুষান বড়ুয়া:
ছিমছাম ছোট্ট একটি গ্রাম- মিয়াপুর (বড়ুয়া পাড়া)। নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ি (সাবেক বেগমগঞ্জ) থানায়, সকল ধর্মের মানুষের বসবাস। এখানে কোনো ভিন্নতা নেই, সকলের সুখে-দুখে সবাই একাকার। ১৯৭১ সালে সবেমাত্র জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সারাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে। তখনো আমাদের গ্রামে যুদ্ধের কোনো ভয়াবহতা অনুভব হয়নি। এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় রাত প্রায় ১২টা হঠাৎ গ্রামের মানুষের ঘুমের নিস্তব্ধতা ভেঙে গুলির শব্দ চারিদিকেই, মানুষে আর্তনাদ যে যেদিকে পারছে ছুটে পালাচ্ছে। সূর্যের লাল আভা ফুটতে, ফুটতে দেখা গেল গ্রাম নয়, যেন এক মৃত্যুপুরী। আশপাশের গ্রামগুলিতেও নিরীহ মানুষের উপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ আর আগুনের লেলিয়ান শিখায় ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে সব। গ্রামের কতিপয় যুবক, অর্ধবয়সী ও বৃদ্ধ পাকহানাদার বাহিনীর এই বর্বরতার কথা আলাপ-আলোচনা করছে। কেউ কেউ দেশকে শত্রুমুক্ত করার কথাও বলাবলি করছিল। মা-বাবা, ভাই-বোন, ছেলে-মেয়েদের শত বাঁধা উপেক্ষা করে দেশপ্রেমের টানে জীবনের মায়া ত্যাগ করে ঝাপিয়ে পড়লেন স্বাধীনতা যুদ্ধে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা।
অত্র গ্রামেরই বীর মুক্তিযোদ্ধা অজিত রঞ্জন বড়ুয়া, পিতা: চন্দ্র মোহন বড়ুয়া, মাতা: নগরবাঁশী বড়ুয়া, বর্তমানে সেনবাগ থানার মতইন গ্রামে বসবাস করেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য গেরিলা শরণার্থী দলের সাথে মিশে সীমানা অতিক্রম করে যুদ্ধকালীন প্রশিক্ষণ ক্যাম্প ভারতের ওম্পি নগরে যুদ্ধকালীন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণ সমাপান্তে ভারতের আগরতলা দিয়ে চৌদ্দ গ্রাম আসেন (সাবেক লাকসাম) গইয়ার ভাঙ্গা এবং (সাবেক চৌদ্দ গ্রাম থানার) বটতলী যাহা বর্তমানে নাঙ্গল কোর্ট উপজেলায় অবস্থিত। বিভিন্ন স্থানে সম্মুখ যুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। এরপর শুধুই জীবন বাজি রেখে সাহসিকতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত রেখে যেতে থাকেন। সহযোদ্ধারা উনাকে নিয়ে গর্ববোধ করেন। যুদ্ধকালীন সময় অনাহারে-অর্ধহারে দিনাতিপাত করেন।
এমন এক সময়ে মুক্তিযোদ্ধারা প্রায় ২ দিন অনাহারে থাকার পর দুপুরে ভাত খেতে বসেছেন। আনন্দের সহিত কেউ খাচ্ছেন কেউ খাবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এমতাবস্থায় সংবাদ পেলেন পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী গইয়ার ভাঙ্গা, পালপাড়া গ্রামে অগ্রসর হয়ে গ্রামের মা-বোনদের ইজ্জ্বত লুণ্ঠন, হত্যা, বাড়ি-ঘরে আগুন সহ বিভিন্ন ধ্বংসযজ্ঞে লিপ্ত। তখন মুক্তিযোদ্ধারা ভাত না খেয়ে শত্রুর মোকাবেলায় ঝাপিয়ে পড়েন, দিনটি ছিল ৬ই রমজান ১৯৭১ সাল। সেদিন মুক্তিযোদ্ধারা দুপুর ১ ঘটিকা হতে সন্ধ্যা ৭ঘটিকা পর্যন্ত পাক হানাদার বাহিনীর সহিত যুদ্ধ করেন। ৬ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়। ২ জন মুক্তিযোদ্ধাকে পাক হানাদার বাহিনী ধরে নিয়ে যায়। পাক হানাদার বাহিনীর ২১ জন লোক মুক্তিযোদ্ধাদের গুলির আঘাতে মৃত্যুবরণ করেন। বহু পাক হানাদার হতাহত হয়। পাক হানাদারদের বহু অস্ত্র মুক্তযোদ্ধারা সংগ্রহ করে। বিভিন্ন জায়গায় পাক হানাদার বাহিনীর সহিত মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখ যুদ্ধ হয়। যুদ্ধকালীন কমান্ডার ছিলেন মো: আব্দুল মালেক ভূঁইয়া (সাবেক লাকসাম) মো: আব্দুল বশর, থানা কমান্ডার (সাবেক লাকসাম) মো: জাকির হোসেন সহ আরো অনেকেই সাহসিকতার সহিত মুক্তিযুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধ করেছেন। ১১ ডিসেম্বর লাকসাম পাক হানাদার মুক্ত করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধকে সফল করার জন্য ৩০ লক্ষ লোক শহীদ হয়েছে। হাজার হাজার মা-বোনেরা ইজ্জত হারিয়েছেন, অনেকে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সহযোগিতা করেছেন বিধায় ঘর-বাড়ি হারিয়েছেন। এখনো অনেক মা, বাবা, ভাই, বোন, স্ত্রী ও ছেলে-মেয়ে পথ চেয়ে আছেন তাহাদের আপনজন মুক্তি পাগল সেই মুক্তিযোদ্ধা ফিরে আসবেন। ভারতীয় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও ভারতীয় তালিকায় অন্তর্ভুক্ত বহু মক্তিযোদ্ধা এখনো সমাজে অবহেলিত ও লাঞ্চিত। এদেরই একজন মহান বীর মুক্তিযোদ্ধা অজিত রঞ্জন বড়ুয়া।
বর্তমানে বার্ধক্যজনিত রোগে জর্জরিত হয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন। অন্যদিকে স্বাধীনতার বিপক্ষের লোকগুলো তার সরলতার সুযোগ নিয়ে জোরপূর্বক পৈত্রিক ভিটা বাড়ি দখল করে এই অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধাকে পথে বসিয়েছে। স্বাধীনতার ৪৭ বৎসর পরও কি রাজাকারদের হাত থেকে মুক্তিযোদ্ধারা রেহাই পাবে না? একজন মুক্তিযোদ্ধার পৈত্রিক ভিটাবাড়ির সকল কাগজপত্র থাকা সত্ত্বেও কিভাবে তাকে ভিটা বাড়ি ছাড়া হতে হয়। এ জন্যই কি জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছিলেন। এই মহান মুক্তিযোদ্ধার জীবন সায়াহ্নে এসে নিজের ভিটাবাড়ির দিকে তাকিয়ে দু’চোখের জল বিসর্জন দেয়া ছাড়া আর কি বা করার আছে। প্রশ্ন তবে একটাই তাহলে কি আমরা স্বাধীন দেশে এখনেও রাজাকার মুক্ত নই?
বীর মুক্তিযোদ্ধা অজিত রঞ্জন বড়ুয়া বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধে জীবন বাজি রেখে যে, যেভাবে কাজ করেছেন সবাই মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধাদের ইতিহাস জানতে হলে জানতে হবে ১৬ই ডিসেম্বর এর চূড়ান্ত বিজয়। এই বিজয় কারো অনুদানে নয়, ৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ৭০ এর নির্বাচন এবং ১৯৭১ সালের বাঙালি জাতির স্বাধীনতা যুদ্ধ। দীর্ঘ সংগ্রামে স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালিত হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে।
এম.কে বড়ুয়া
সভাপতি
সোশ্যাল রাইটস্ এসোসিয়েশন
০১৭১১-৯৬৪২১৯