
আবদুল্লাহ মজুমদার : কাউকে নিয়ে লেখা মানে কারো শত্রু হওয়া ছাড়া কিছু নয়; যেমন “বোবার শত্রু নাই”! তাই বলে কী বোবা থেকে যাবো? নাহ! আমি কথা বলার মানুুষ, বোবা থাকতে চাই না! বাস্তবতাকে মেনে পথচলার এক সাহসী পুরুষও বলেছে অনেকে আমাকে। সেজন্য কারো জন্য লিখার প্রয়োজন হলে বিলম্ব করি না, সোজাসাপটা লিখে ফেলি…..। এজন্য অনেকের অপ্রিয় হতে পেরেছি। আমি সাহিত্যের নগন্যজন, চুনোপুঁটিও নই। তবে সাহিত্যের সেবক হওয়ার চেষ্টা অবিরাম সে সুবাদে প্রিয় হতে পেরেছি কিছু সংখ্যক প্রতিবাদীজনের। সে যাক, আসল কথায় আসি–
মোস্তফা হায়দার এর সাথে পরিচয়ের সূত্রটা ঠিক মনে করতে না পারলেও সম্ভবত কোনো এক সাহিত্যের আড্ডায় কবি, সংগঠক ও সব্যসাচী লেখক মোস্তফা হায়দার কে প্রথম দেখেছিলাম। সেদিন কবিকে অবয়বে তেমন একটা ভালো না লাগলেও তাঁর লেখা পাঠে খুঁজে পেয়েছিলাম অনন্য প্রতিভা। অবশ্য মোস্তফা হায়দারের লেখার সাথে পরিচয় অনেক বছরের, অনেক বছর বলতে দুই-যুগ এর বেশি বৈ কম হবে না।
লিটল ম্যাগ থেকে শুরু করে, সাহিত্যের ছোট-ছোট কাগজেও মোস্তফা হায়দার লেখালিখি করেন। দেশের জাতীয় ও স্থানীয় দৈনিকগুলোর সাহিত্য পাতায় যার হৃদয়গ্রাহী লেখায় সাহিত্যাঙ্গনে ফুরফুরে একটি ভাব বিরাজ করে। শিল্প-সাহিত্যের এক উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় নক্ষত্র বললেও অত্যুক্তি হবে না কবি ও সাহিত্য সমালোচক মোস্তফা হায়দারকে। সনেটের বিদগ্ধ কবি আল মাহমুদ গবেষক মোস্তফা হায়দার নিজেও সাহিত্যাঙ্গনে অতি পরিচিত ও গ্রহণযোগ্য একটি নাম।
মোস্তফা হায়দারকে নিয়ে স্মরণিকা প্রকাশ হবে জেনে পুলকিত আমিও। টাকা-পয়সার মাঝে লুকিয়ে থাকা এ মানুষটি সাহিত্যের গভীরে বসবাস করছেন একথা ভাবতে ভালোই লাগে। অবয়বে ভালো লাগা না লাগা যে কথাটি আমি উপস্থাপন করেছি তার ব্যাখ্যা একান্তই আমার ! মানে কাউকে প্রথম দেখাতে ভালো লাগলে তার সম্পর্কে জানার আগ্রহ আর থাকে না। আর কাউকে প্রথম দেখাতে ভালো না লাগলে তার সম্পর্কে জানার আগ্রহ বাড়ে– মোস্তফা হায়দার তেমনি একজন মানুষ। একজন শাদামনের মানুষ। বাইরের অংশ দেখে একজন মানুষকেকখনোই মুল্যায়ন করা ঠিক না এমন কথা নিরেট সত্যতা মিলে।
কবি, গবেষক ও সাহিত্য সমালোচক হাফিজ রশিদ খান মোস্তফা হায়দার প্রসঙ্গে বলেছিলেন- কবিতার নিধুবনে দীর্ঘ ভ্রমণে আছেন মোস্তফা হায়দার। তার সহজ মনের স্তোত্রগুলো ঘাস-গালিচার মতো আনন্দ দেয়। কখনো বা উঁকি দিয়ে যায় বেদনা ও বিমনা সংলাপও। ব্যক্তি তো আসলে নিরংকুশ একা নয়। যৌথতার সঙ্গে তার আংটা জড়িয়েই থাকে কোনো না কোনোভাবে। আর সেই ব্যক্তিসত্তা যখন কবিতার ভ্রামণিক হন, তার অ্যান্টেনায় সমাজসত্তার কিছু-কিছু ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তো টংকার তুলবেই। মোস্তফা হায়দার সেই অর্থে সচেতন কবি। তাই রাষ্ট্র ও রাষ্ট্র বহির্ভূত মানুষ ও তাদের ক্ষোভ-ক্রোধের অনুনাদ শ্রুত হয় তার পঙক্তির কাতারে।
আবার নির্জলা বা কট্টর সচেতনও বলা যাবে না এ কবিকে। কেননা কিছু লোহিতাভ প্রণয়কাতরতাও তাকে গাঢ় করে কাছে টানে মায়া ও মমতার মতো।
একটি পুরোদস্তুর মানবিক অস্তিত্বের রাগ-অনুরাগের অক্ষরমালায় মোস্তফা হায়দার সময়ের কণ্ঠস্বর। সময়ের কবিতায় যৌথ কোরাসও।
একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকজুড়ে কবিতা, লিটনম্যাগচর্চায় মোস্তফা হায়দার নিজেকে বিকশিত করেছেন নিষ্ঠার সঙ্গে। ‘সাগরকন্যা’ নামীয় ছোটকাগজে একালের তরুণ-তরুণীদের সাহিত্যমুখী কলরব মুদ্রিত করে চলেছেন।
সাহিত্যচর্চার মানবীয় বিতানে তার কবিতা এদেশের মানুষের, নদী-নিসর্গ, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কথা হৃদয়ের আলোয় উচ্চকিত করে তুলবে, এমন আভাস তার ‘চৈতালিপার্বনে কাঁচা মাংস’ ধারণ করেছে।
মোস্তফা হায়দার আগামী দিনগুলোতে কবিতার কমলকামনে প্রস্ফুটিত পুণ্ডরীকের প্রতিভু হয়ে উঠবেন, এই প্রত্যাশা লালন করি অন্তরতলে।
মোস্তফা হায়দার লেখক নন শুধু, লেখক গড়ার কারিগরও। নিরবে নিবৃত্তে লেখক তৈরিতে যার অবদান অনস্বীকার্য তিনিই মোস্তফা হায়দার।
মোস্তফা হায়দার কবিতার পাশাপাশি লেখেন ঘটে যাওয়া সময়ের গল্প। ছোটো গল্প লিখলেও সময়ের চাহিদায় শিশুকিশোর ছড়া, গল্প প্রবন্ধ- সমালোচনা সাহিত্যেও কাজ করে চলেছেন।
১৯৭৯ সালের ৮ এপ্রিল সন্দ্বীপ উপজেলার গাছুয়া ইউনিয়নের মোহাম্মদপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন মোস্তফা হায়দার। সার্টিফিকেটে ১০/১/১৯৮৪ হলেও মূলদিনটি হাতে রেখে ৮৪কে বহন করে চলেছেন। বাবা আবুল কালাম পেশায় চাকুরীজীবি ছিলেন। পিসি আই সিরামিকে। চার ভাই এক বোনের মধ্যে তিনি সবার বড় মোস্তফা হায়দার সন্দ্বীপের প্রাচীন কাটগড় ইসলামিয়া ফাজিল (ডিগ্রী) মাদ্রাসা থেকে দাখিল করার পর সীতাকুন্ড আলিয়া থেকে কামিল শেষ করেন। চট্টগ্রাম কলেজে অনার্স থার্ড ইয়ার থেকে শিক্ষাবিরতি ঘটে দাসত্বের কৃচ্ছতায়।
অধুনালুপ্ত মুরাদপুর সীতাকুণ্ডের একটি দাখিল মাদ্রাসায় সহসুপার পদে ২০০৪ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত খেদমত করে গেছেন। ফেমাস ফার্মাসিউটিক্যাল নামে একটি মেডিসিন কোম্পানিতে এম আর হিসেবে জয়েন করে মার্কেটে যাওয়ার প্রথম দিনেই রিজাইন দেয়। ২০০৫ এর এপ্রিল থেকে অদ্যবধি কর্মরত একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে।
নিবেদিত সাহিত্য-সংস্কৃতি: সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চায় । ছাত্রজীবনে সন্দ্বীপে পাঞ্জেরি পরিষদ, সীতাকুণ্ডে সঞ্চারী শিল্পগোষ্ঠীর সাথে সুস্থ ও প্রগতি ধারার সংস্কৃতি চর্চা করে গেছেন। ২০০৪ সালে চট্টগ্রাম টেলিভিশনে সঞ্চারী শিল্পগোষ্ঠীকে নিয়ে দিশারী প্রোগামে সংগীত পরিবেশন করেন এবং প্যারোডি গানের ক্যাসেট ‘মানুষ এমন হইল ক্যান’ বের করেন যৌথ সংগীতে। এখন নিয়মিত সাহিত্যসংগঠনের সাথে কাজ করে চলেছেন। সাহিত্যবিশারদ সুহৃদ চট্টগ্রাম, সন্দ্বীপ সাহিত্য পরিষদ এর সাথে কাজ করেন। সাগরকন্যা সাহিত্য একাডেমি এবং দায়িত্বে আছেন “জোছনা গণগ্রন্থাগার ও জনকল্যাণ ফাউন্ডশন”র ।
নবমশ্রেণিতে স্বরচিত কবিতা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার মধ্যদিয়ে কবিতায় তার অবস্থান পরিস্কার হয় মোস্তফা হায়দার এর। সীতাকুন্ডের গোলাপকলির উচ্ছ্বাস ম্যাগাজিনে প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় ২০০০ সালে। তারপর থেকে চট্টগ্রাম, ঢাকা, সারাদেশসহ দু-বাংলা এবং জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে তার গল্প ও কবিতা।
১.কলস ভাঙে জলের ভারে (কাব্যগ্রন্থ-২০০৮সালে) জাগৃতি প্রকাশন। ২.জীবন্ত কঙ্কালের প্রোতমুখ ( কাব্যগ্রন্থ ২০০৯সালে) সাউন্ডবাংলা প্রকাশন। ৩.ভূতের সাথে লড়াই (শিশুতোষ গল্প ২০০৯ সালে) সাউন্ডবাংলা প্রকাশন। ৪. চৈত্রের বিকেলে(গল্পগ্রন্থ -২০১০ সালে) প্রতিভা প্রকাশ। ৫. জলের সানকি (কাব্যগ্রন্থ ২০১০সালে) সাহিত্যদেশ প্রকাশন। ৬. দয়িতার অভিমান (কাব্যগ্রন্থ-২০১১সালে)। ৭. নব্যস্বৈরাচারের বিষফোঁড়(কাব্যগ্রন্থ-২০১২) সাহিত্যদেশ প্রকাশন। ৮.কাঁদছে স্মৃতির স্বয়ম্ভরা(কাব্যগ্রন্থ-২০১৪সালে) চর্চাগ্রন্থ প্রকাশ।। ৯. লাল সবুজের পতাকা পৃথিবীর পাসপোর্ট (কাব্যগ্রন্থ- ২০১৮) দেশজ প্রকাশন।। ১০.রাতুলের ফার্স্ট ডিভিশন(কিশোর গল্পগ্রন্থ-২০২১)। ১১. চৈতালিপার্বণে কাঁচা মাংস, কাব্যগ্রন্থ (ইনভেলাপ পাবলিকেশন্স ২০২৩)।
এযাবৎ যেসব উল্লেখযোগ্য পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন মোস্তফা হায়দার তারমধ্য-
প্রিয়জন সেরা কবির পুরস্কার- ২০০৭- (দৈনিক নয়াদিগন্ত)। নবীন লেখক সম্মাননা ২০০৮ ( পাক্ষিক খবরিকা-মীরসরাই)। সাউন্ড বাংলা পদক- ২০০৯ (সাউন্ড বাংলা প্রকাশন,ঢাকা)। মুক্ত লেখক লেখনী সম্মাননা ২০০৯ (সাতক্ষীরা)। শিশু কবি রকি সাহিত্য পুরস্কার ২০১০। লেখক সংবর্ধনা ২০১১ ( প্রতিভা প্রকাশন,ঢাকা)। বাংলাদেশ কাব্যচন্দ্রিকা সাহিত্যপদক ২০১৫ (রংপুর)। দেশজ পাণ্ডুলিপি পুরস্কার ২০১৭ (দেশজ প্রকাশন)। সার্বিকসাহিত্যে দোনাগাজী পদক ২০১৯ ( চর্যাপদ একাডেমী- চাঁদপুর) ও দিগন্ত সাহিত্য পুরস্কার ২০২২ উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও মোস্তফা হায়দার সম্পাদনা করেন সাহিত্যের ছোটো কাগজ ‘সাগরকন্যা ও তরুপত্র। দেখাশোনা করেন তরুমন প্রকাশন।
বাজারে প্রচুর লেখক এখন, সবাই সবার প্রিয় বা পছন্দের হতে পারে না। তবে মোস্তফা হায়দার ব্যক্তিগতভাবে আমার একজন পছন্দের ও ভালোলাগার মানুষ। সোজা কথা যখন-ই কবির সাথে সাক্ষাৎ হয় একসাথে বসে এককাপ চা- না খেলে বা জমিয়ে আড্ডা না দিলে অপ্রাপ্তিতে ভুগি। সহজ-সরল শাদামনের এ লেখক আপাদমস্তক একজন সামাজিক মানুষও। সমাজ বিনির্মানেও যার ভূমিকা অগ্রণী। লেখক : সংগঠক ও সাংবাদিক


















