আজ : শুক্রবার ║ ১৩ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

আজ : শুক্রবার ║ ১৩ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ║২৮শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ║ ১১ই জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি

আগামী ৩০ অক্টোবর মৃত্যু বার্ষিকী স্মরণ : সাংবাদিক হেলাল হুমায়ুন : অতুলনীয় সহকর্মী

ওমরফারুক
শেষ দেখা ত্রিশ অক্টোবর সন্ধ্যা সাতটা দু’হাজার ষোল। এর আধঘন্টা পরে তাঁর না ফেরার দেশে যাত্রা। তাঁর চিরপ্রস্থন আমাকে দারুনভাবে আহত করে। চট্টগ্রাম ন্যাশনাল হাসপাতালের আইসিইউ-তে ওই সাক্ষাতে তিনি বললেন, ঠিকমতো অফিস করো,আগামী দু’দিন পর ছুটি শেষে কাজে যোগ দিব। মৃত্যুর আগ মুহুর্ত পর্যন্ত কাজ পাগল মানুষটি জাগতিক মোহের উধ্বে উঠে কেবল কাজ করেছেন নিভৃত মনে।
নয়াদিগন্ত পত্রিকার চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান ও বিশেষ প্রতিনিধি মরহুম হেলাল হুমায়ুন ব্যক্তিগত জীবনে সাদাসিদে,সৎ,ধার্মিক,নির্ভীক, সদাহাস্যোজ্জল ও মৃদুভাষী কিন্তু অত্যন্ত প্রত্যয়ী ছিলেন। তিনি ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গী ও গঠনমূলক চিন্তার অনুসারী ছিলেন। তাঁর লেখায় সাহিত্যের ছোঁয়া,পাণ্ডিত্য ও দার্শনিক প্রজ্ঞা ছিল।
২০০৬ সালে দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকায় চট্টগ্রাম ব্যুরোতে আমি কাজ করার সময় থেকে হুমায়ুন ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয়। তবে ২০১২ সালে নয়াদিগন্তে আমার যোগদানের সুবাদে তাঁর সাথে ঘনিষ্টভাবে কাজ করার সুযোগ হয়। আমার জানা মতে তাঁর কোন শত্র“ ছিল না। বাচন ভঙ্গিতে চলাফেরায় তিনি কখনোই আক্রামণাত্বক ছিলেন না। নিউজ করার ব্যাপারেও তাঁর উৎসাহ আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে। অফিসে তার হাসিখুশি চেহারা আমাদের মুগ্ধ করতো। মানুষের ছোট কাজগুলো তিনি বড় করে দেখতে ভালবাসতেন। তার অসংখ্য প্রমাণ পেয়েছি। আসলে হেলাল হুমায়ুন ভাই সব সময় এমনই।
সময়টা ২০১৫ সালের আগষ্টের দিকে হবে হয়তো। তার পরামর্শে ‘চট্টগ্রামে মাদকের ভয়াল থাবা’ শিরোনামে পাঁচ পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদন তৈরি করি, যা নয়াদিগন্তে প্রকাশিত হয়। প্রথম আলো ট্্রাস্ট মাদকবিরোধী সেরা প্রতিবেদন পুরস্কারের জন্য রিপোর্টগুলো মনোনীত হয়। ২০১৬ সালের ২৯ অক্টোবর পুরস্কার নিতে ঢাকায় প্রথমআলোতে যাওয়ার একদিন আগে দোয়া নিতে গিয়েছিলাম হুমায়ুন ভাইয়ের বাসায়। তখন তিনি খুব অসুস্থ ছিলেন। তারপরও ঘন্টাখানেক কথা বলেছিলেন তিনি। বিদায় প্রাক্কালে তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে অঝুর কেঁদে ফেললেন। ঢাকায় যেতে দু’হাজার টাকা গাড়ি ভাড়া জোর করে দিয়ে আমাকে বললেন ‘এটা তোমার পুরস্কারের পুরস্কার’। ঢাকা অফিসে তিনি আগে থেকে বলে রেখেছিলেন প্রথম আলো থেকে আমার পুরস্কার প্রাপ্তির নিউজটা যেন ভালভাবে ট্্িরটমেন্ট দেয়। যেদিন পুরস্কার পেলাম, পত্রিকায় সংবাদটি প্রকাশিত হল সেদিন তিনি আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে চিরনিন্দ্রায় চলে গেলেন। মানুষটির অমৃত সাহচর্য আমার মানস গঠনে যথেস্ট ভূমিকা রেখেছে। হেলাল ভাই আমার চোখে সুলেখকের পাশাপাশি একজন দার্শনিক,সমাজ সংস্কারক,ধর্ম-ইতিহাসবেত্তা সর্বোপরি পাণ্ডিত্য ও জ্ঞানগরিমায় এক অনন্য পুরুষ।
তাঁকে নিয়ে লিখতে গিয়ে অনেক স্মৃতি আমার অবলীলায় মনে পড়ে যাচ্ছে। সহকর্মীদের জন্য তাঁর ঐকান্তিক প্রচেস্টা ও আন্তরিকতার কমতি ছিলনা। তিনি ছিলেন আমাদের পরম বন্ধু। তাঁর সাথে ছিল আমার গভীর সম্পর্ক। বিষয়টি ছিলো বিশেষ রিপোর্ট লেখালেখি ও পঠন-পাঠন নিয়ে। তিনি প্রতিদিন নিউজ’র বিষয় নিয়ে আলাপ করতেন। আমার মতামতের গুরুত্ব দিতেন। তিনি ছিলেন বিনয়ী, সংযত,অমায়িক স্বভাবের। খুব সহজে সহকর্মীদের সাথে মিশে যেতে পারতেন; অনায়াসে সবাইকে আপন করে নিতে পারতেন।
তাঁর জ্ঞানের পরিধি এতই ছিল যে নিউজের যে কোন বিষয় জানতে চাইলে সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিতেন।
নয়াদিগন্তের চট্টগ্রাম ব্যুরোতে প্রতিদিন জ্ঞানী-গুণীর আড্ডায় জমজমাট থাকতো। এ আসরের মধ্যমণি ছিল হেলাল ভাই। যারা তাঁর সাথে মিশেছেন, তাঁরা জানেন কী অসাধারণ পাণ্ডিত্য ছিল তাঁর। বাংলা,আরবি,হিন্দি, উর্দু,ফার্সি ও ইংরেজি সাহিত্যের উপর অসাধরণ দখলে তিনি জ্ঞানের সাগর ছিলেন। এক কথায় তিনি ছিলেন আলোময় মানুষ। পাণ্ডিত্যকে উদ্ধুদ্ধ ও আনন্দময় করতে তিনি আল্লামা রুমী, শেখ সাদী, মীর্জা গালিব ও তার পিতা কবি হিলালীর শে’র আর গজল শোনাতেন উর্দু আর ফার্সিতে। অফিসের গাম্ভীর্য তখন কিছুক্ষণের জন্য ভেঙ্গে যেতো। তাঁর কাছে কেউ আসলে সহকর্মী হিসেবে আমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিত। পরিচয়ে তিনি এভাবে বলতেন, আমাদের ওমর ফারুক দারুন সংবাদ প্রতিবেদন তৈরি করতে পারে, কবিতা ও প্রবন্ধ লিখে। তার হাতের লেখাও ভাল। হুমায়ুন ভাই যখন আমার সম্পর্কে কথাগুলো অতিথিদের বলতেন,আমি তখন লজ্জায় কুঁকড়ে যেতাম। তাঁর সাথে আমার বয়সের ব্যবধান পিতা-পুত্রের। তারপরও সহকর্মী হিসেবে আমাদের সম্পর্কটা ছিল মজার।
সজ্জল ব্যক্তিত্ব হেলাল হুমায়ুন কর্মক্ষেত্রে মূল্যরোধ,সচেতনতা ও রুচির স্বাক্ষর রেখেছিলেন। তাঁর মতো পরিশ্রমী মানুষ আমি কম দেখেছি। সকাল ৯টায় অফিসে এসে অনেক সময় রাত ১০টায় বাসায় ফিরতো। তাঁর উদ্দামি দেখে আমি বিস্মিত হতাম। কোথায় কী ঘটনা ঘটছে, কী অনুষ্ঠান হচ্ছে খবর রাখতেন। যা অনেক ব্যুরো প্রধানের পক্ষে সম্ভব হতো না। প্রায় সময় বিশেষ রিপোর্ট তৈরিতে তাঁর সহযোগিতা নিতাম। তিনি এতে মোটেও বিরক্ত হতেন না বরং উৎসাহ যোগাতেন। নিউজ সংগ্রহে তাঁর ব্যক্তিগত সোর্সদের যেমন পরিচয় করে দিতেন,তেমনি বিভিন্ন রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, শিল্পপতি-ব্যবসায়ী ও সমাজিক ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে আমাদের পরিচিত করে তুলতেন। নয়াদিগন্তের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, অফিসের উধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে একইভাবে আমাদের সম্পর্ক গড়ে তুলতে সহযোগিতা করতেন। সহকর্মীদের প্রতি তাঁর মনুষ্যত্ববোধ, মানবিকতা ও বিশ্বাস ছিল অগাধ। সব বিটের নিউজের তথ্য উপাত্ত ছিল তার নখদর্পণে। নীতির ক্ষেত্রে তিনি আপোষ করতেন না। নিজের বিশ্বাস থেকে তাঁর কখনো পদঙ্খলন ঘটতে দেখিনি। এটাই প্রমাণ করে তাঁর চারিত্রিক দৃঢতা,আত্মবিশ্বাস ও পেশার প্রতি নিষ্ঠা।
তিনি সহকর্মী হিসেবে অনন্য,অতুলনীয় একজন। একজন মানুষের অনেকগুলো গুণ থাকে। কোন একটা গুণকে কেন্দ্র করে মানুষ এগিয়ে যায়। হেলাল ভাই একদম আলাদা। তাঁরমধ্যে অনেকগুলো গুণের সমাবেশ ঘটেছে। একটি বাতিঘর চারপাশের কালোকে যেমন আলোতে ভরে দেয়,ঠিক তেমটিই ছিলেন সহকর্মী হিসেবে। তাঁকে সহজে ভোলার নয়।
হেলাল হুমায়ুন ভাইয়ের মৃত্যু হয়েছে সেটা আমি বলতে পারি না। যেমন তাঁর জানাজায় নয়াদিগন্তের হেড অব নিউজ আজম মীর ভাই বলেছেন-মনেই হয় না হেলাল ভাই আর নেই। আমরাও মনে করি না তিনি নেই। মনে হয় তিনি ছুটি কাটাতে গেছেন । তিনি কোন এক সকালে অফিস থেকে টেলিফোন করে বলবেন, ফারুক আমি অফিসে আছি,তাড়াতাড়ি এসো। এ্যাসাইনমেন্টে যেতে হবে। #

লেখক ওমর ফারুক,স্টাফ রিপোর্টার দৈনিক নয়াদিগন্ত চট্টগ্রাম ব্যুরো।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

আজকের সর্বশেষ সংবাদ