
কক্সবাজার প্রতিনিধি : কক্সবাজার ঈদগাঁও উপজেলায় চলছে সরকারি নীতিমালা উপেক্ষা করে ভাটায় ইট পোড়ানোর কাজ । যে কয়েকটি ভাটা রয়েছে অধিকাংশ ইট ভাটা পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র ছাড়াই ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা, সংরক্ষিত বনসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আশপাশে ও ফসলি জমিতে স্থাপন করা হয়েছে।
খবর নিয়ে জানা যায়, ঈদগাঁও উপজেলার সদর ইউনিয়নে তিনটি, ইসলামাবাদ ইউনিয়নে তিনটি, চৌফলদন্ডী ইউনিয়নে একটি ও জালালাবাদ ইউনিয়নের দু’টি ইট ভাটায় প্রায় এক মাস আগে থেকেই বনজ গাছ পোড়ানো হচ্ছে। এ বছর মৌসুমের আগেই শুরু হয়েছে ইট তৈরি ও পোড়ানোর কাজ। কিন্তু কয়লার দাম গত বছরের চেয়ে তুলনামূলক বেশি থাকায় কয়লার পরিবর্তে এখানকার নয়টি ইট ভাটায় অবাধে বনের কাঠ পোড়ানো হচ্ছে।
এতে স্বাস্থ্যঝুঁকির পাশাপাশি মারাত্মক হুমকির মুখে রয়েছে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র। আইন অমান্য করে দিনের পর দিন ইট ভাটার সংখ্যা বাড়লেও প্রশাসনের নীরব ভূমিকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। প্রভাবশালীদের হাত বদল করে দীর্ঘ বছর যাবৎ চলছে প্রায় ০৯ টি ইট ভাটা। প্রশাসন এমন অভিযোগ অস্বীকার করে নিরব ভূমিকা পালন করে চলছে।
অবৈধভাবে গড়ে ওঠা এসব ইট ভাটায় প্রকাশ্যে পোড়ানো হচ্ছে বন ও সামাজিক বনায়নের বাগানের কাঠ। কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে কৃষি জমির মাটি। ফলে একদিকে নির্বিচারে উজাড় হচ্ছে বন, অন্যদিকে উর্বরতা হারিয়ে চাষের অযোগ্য হয়ে পড়ছে আবাদী জমি। অনিয়শ্চতা দেখা দিয়েছে আগামীর কৃষির উর্বরতানিয়ে ।
এ দিখে ইট তৈরির কাঁচা মাল মাটির জন্যে লুট করা হচ্ছে উপজেলার শত শত একর ফসলী জমির টপ সয়েল। স্কেবেটার দিয়ে ফসলী জমির উর্বর টপ সয়েল কাটা হয়েছে প্রভাবশালী স্কেবেটার সিন্ডিকেটের মাধ্যমে।
টপ সয়েল লুন্টনের ফলে আগামী কয়েক মৌসুমে কৃষি উৎপাদন অর্ধেকে নেমে আসার আশংকার কথা জানিয়েছেন উপ-সহকারি কৃষি কর্মকর্তা সুব্রত দাশ জিকু।
বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, আকারভেদে একটি ইট ভাটা গড়তে কমপক্ষে পাঁচ একর (৫০০ শতাংশ) জমি প্রয়োজন। তবে ক্ষেত্র বিশেষে ৪০ থেকে ৪৫ একর জমিরও প্রয়োজন হয়। একটি অবৈধ ইট ভাটা গড়ে ওঠার কারণে চার শতাধিক একর ফসলি জমি নষ্ট হয়েছে।
ভাটায় কাঠ পোড়ানো আইনত নিষিদ্ধ হলেও অভিযোগ রয়েছে এসব কাজে পরোক্ষ ইন্ধন দিচ্ছে অসাধু বন ও পরিবশে কর্মকর্তারা। ইট ভাটায় উপজেলা প্রশাসনের কোন অভিযান এ পর্যন্ত চোখে না পড়লেও ফসলি জমির টপ সয়েল রক্ষায় বেশ কয়েকটি ভাম্যমাণ অভিযান করে জরিমানা আদায় করেছেন উপজেলা প্রশাসন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ইট ভাটার ম্যানেজার জানালেন, সাধারণত মধ্যম সারির একটি ভাটায় বছরে ৪০ থেকে ৫০ লাখ ইট পোড়ানো হয়। আর প্রতি ৮ হাজার ইটের জন্য কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার হয় এক হাজার ঘনফুট মাটি। তা ছাড়া তারা বিভিন্ন বন থেকে সংগৃহীত কাঠ এসব ভাটায় জোগান দেন।
ভাটায় ঘুরে দেখা গেছে, ভাটার মালিকের ঘর সহ বিভিন্ন স্থানে মজুদ করা হয়েছে সামাজিক বনায়নের বাগানের কাঠ এখান থেকেই নিয়ে গিয়ে আবার ভাটায় পুড়ানো হচ্ছে প্রতিদিন এ সংরক্ষিত কাঠ।
অথচ বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১০) এবং পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা ১৯৯৭-এর ৭ ধারা অনুযায়ী কাঠ দিয়ে ইট পোড়ানোকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। এ আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে অর্থদণ্ড জেল বা লাইসেন্স বাতিল ও ইট ভাটা বাজেয়াপ্ত করারও বিধান রয়েছে। কাগজে-কলমে এসব আইন বাস্তবায়নে কঠোর নির্দেশনা থাকলেও বাস্তবে উল্টো নীতিতে বন ও পরিবেশ অধিদফতরসহ জেলা-উপজেলা প্রশাসন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইট ভাটার আরএক কর্মচারী জানান উপজেলার সবাই ইট ভাটা মালিকরা সিন্ডিকেট করে উপজেলা প্রশাসন, বন বিভাগ, পরিবেশ অধিদপ্তরে মাসোহারা দিয়ে ম্যানেজ করে ইট ভাটায় বনের কাঠ পুড়ানো হচ্ছে এবং ব্যবহার করা হচ্ছে ইটের কাঁচামাল ফসলী জমির টপ সয়েল।
আরো জানা যায় স্থানীয় ও দূরবর্তী বিভিন্ন বন থেকে গাছ চোর সিন্ডিকেট এসব গাছ কেটে ইট ভাটায় সরবরাহ করছে। ঈদগাঁওর সংরক্ষিত বনাঞ্চল ছাড়াও পাশের রামু ও চকরিয়া উপজেলা এবং সুদূর লামা-আলী কদম থেকেও বনজ গাছ এনে এখানকার ইট ভাটায় পোড়ানো হচ্ছে। দ্বীপ উপজেলা মহেশখালীর উপকূলীয় ম্যানগ্রোভ প্যারাবন থেকে কেওড়া গাছ কেটে কার্গো ট্রলারযোগে ইসলামপুর শিল্প এলাকায় খালাস করছে গাছ চোরেরা। এসব গাছ রাতের আঁধারে সরবরাহ করা হচ্ছে বিভিন্ন ইট ভাটায়। চোরাই এসব বনজ গাছ মজুদ ও সরবরাহ করা সুবিধার্থে উপজেলার বিভিন্ন স্থানে গড়ে তোলা হয়েছে ডজনখানেক অবৈধ গাছের ডিপো।
ঈদগাঁও বাস স্টেশনের পূর্ব পার্শ্বে একটি, স্টেশনের দক্ষিন পার্শ্বে গরুর বাজার এলাকায় একটি, বাস স্টেশনের উত্তর পার্শ্বে ইসলামাবাদ খোদাই বাড়িতে দু’টি, ঈদগাঁও বাজার সংলগ্ন জাগির পাড়ায় একটি, মেহের ঘোনায় একটি, জালালাবাবাদ ফরাজী পাড়ায় একটি ইসলামাবাদ বোয়ালখালীতে দু’টি, চৌফলদন্ডীতে দু’টিসহ প্রায় এক ডজন অবৈধ কাঠের ডিপো গড়ে উঠেছে। এসব ডিপোতে অনুমানিক তিন হাজার টন চোরাই বনজ গাছ মজুদ করা হয়েছে ধারণা করা হচ্ছে।
এসব অনিয়মের কারণে সর্বশেষ ২০২২ সালের ডিসেম্বরে উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে বেশ কয়েকটি ভাটায় অভিযান পরিচালনা করে জরিমানা করলেও বর্তমানে তেমন কোন তৎপরতা না থাকায় চলতি বছর পূর্বের প্রক্রিয়ায় ইট পুড়িয়ে বাজারজাত করা হচ্ছে।
এদিকে, ইট ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩-তে বলা হয়েছে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আবাসিক এলাকা, বাণিজ্যিক এলাকা, হাট-বাজার এলাকা; সিটি করপোরেশন, পৌরসভা বা উপজেলা সদর এবং বন, অভয়ারণ্য, বাগান, জলাভূমি ও কৃষি জমিতে ইট ভাটা স্থাপন করা যাবে না। সংরক্ষিত বনের ১০ কিলোমিটারের বাইরে ইট ভাটা করার বিধান থাকলেও খোদ সংরক্ষিত বনের নিকটে ও ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা ও ফসলি জমিতেই রয়েছে অধিকাংশ ইট ভাটা। আইনের তোয়াক্কা না করেই অধিকাংশ ইট ভাটা স্থাপন করা হয়েছে ঘনবসতি সংলগ্ন ফসলি জমিতে।
ইট ভাটার ধোঁয়ায় পরিবেশ দূষণ ছাড়াও স্থানীয়রা কাশি, সর্দি, অ্যাজমা, ডায়রিয়া ও এলার্জির মতো নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হওয়ার কথাও জানিয়েছেন।
কাজল ও রফিকুল ইসলামসহ নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইসলামাবাদ বোয়ালখালীর স্থানীয় কয়েকজন কৃষক বলেন, ভাটার বিষাক্ত ধোঁয়ায় ফসলি জমির ক্ষতি হচ্ছে। ক্ষেতের পাশে ইট ভাটা গড়ে ওঠায় আগের তুলনায় ফসলের উৎপাদন কমে গেছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জানান, ইটভাটায় ঝিকঝাক পদ্ধতি অনুসরণ না করার কারণে ভাটার আশপাশের ফসলি জমির উৎপাদন দিনদিন হ্রাস পাচ্ছে। ধানের চেয়ে চিটার পরিমাণ বেড়ে যাওয়াসহ অন্যান্য ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। সরকার ফসলি জমির ওপর ইট ভাটা স্থাপন রোধে দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এসব জমির উৎপাদন শূন্যে নেমে আসবে।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা জানান, ইট ভাটার ধোয়ায় অক্সিজেন স্বল্পতার কারণে মানুষের চর্মরোগ, অ্যাজমা, হাঁপানিসহ ডায়রিয়া রোগের প্রকোপ দেখা দেয়।
কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের আওতাধীন ঈদগাঁও রেঞ্জ কমকর্তা আনোয়ার হোসাইন খান বলেন, ইট ভাটাসমূহে পোড়ানো বনের গাছ আছে চোরাই পথে। জনবল সংকটের কারণে চোরাই পথে বনের গাছ পাচার রোধ করা শতভাগ সম্ভব হচ্ছে না। উর্ধ্বতন অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করে উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে বনের গাছ পাচার ও বনজ সম্পদ ধ্বংসকারীদের বিরুদ্ধে শীঘ্রই অভিযান পরিচালনা করা হবে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুবল চাকমা মুটোফোনে বক্তব্য দিতে অসম্মতি প্রকাশ করেন।
বন ও পরিবেশ অধিদফতরের অবৈধ ইট ভাটা বন্ধের নির্দেশ সর্ম্পকে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে মুঠোফোনে আলাপ করার চেষ্টা করলে তিনি কল রিসিভ না করাই বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
ঈদগাঁও উপজেলার পরিবেশ অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত ইট ভাটার সংখ্যা জানতে পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার অঞ্চলের পরিচালকের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি উপ-পরিচালকের সাথে যোগাযোগ করতে বলেন। পরে উপ-পরিচালক নুরল আমিনের সঙ্গে মুটোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ছুটিতে আছেন বলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।