পণ্ডিত তরুণ কুমার আচার্য কৃষ্ণ:
“ভুলে যাও শোক-চোখে জল ব’ক
শান্তির-আজি শান্তি-নিলয় এ আলয় হোক।
ঘরে ঘরে আজি দীপ জ্বলুক!
মা’র আবাহত-গীত চলুক।
দীপ জ্বলুক!
গীত চলুক!!
আজ কাঁপুক মানব-কলকল্লোলে কিশলয় সম নিখিল ব্যোম!
স্বা-গতম্
স্বা-গতম্!!”
যার আগমনির বার্তা শুনে মন উল্লসিত হয়ে ওঠে, যার আসার সময় উপস্থিত হইলে মন ধৈর্যের বাধ মানে না, মরেন মধ্যে আনন্দের উদ্বেল উচ্ছ্বাস বেয়ে উঠে, তিনি হলেন আমাদের সবার প্রিয় ‘শারদমাতা’।
বঙ্গদেশে দুর্গাপূজা সাধারণত স্মার্ত রঘুনন্দনের তিথিতত্ত্ব গ্রন্থে ‘দুর্গোৎসবতত্ত্ব’ অনুসরণ করে পালিত হয়। দুর্গার মহাদেবী রূপকল্পনাকে বাংলার ঘরে ঘরে আদরনীয় ও সম্মানীয় করার জন্য স্মার্ত পণ্ডিত রঘুনন্দন তার অসাধঅরণ কল্পনাশক্তির প্রভাবে পুত্রকন্যাসহ মৃন্ময়ী দুর্গা প্রতিমা পূজার বিধান দিয়েছিলেন। শাস্ত্রে একটি ঋতুচক্রে বা বছরের মধ্যে দুবার দুর্গাপূজার বিধান লিপিবদ্ধ আছেÑএকটি বসন্তকালে, অপরটি শরৎকালে। শরৎকালে অনুষ্ঠিত দুর্গাপূজাকে বলে শারদীয়া পূজা। এটি অকালবোধন নামেও পরিচিত। মূল রামায়ণে ‘অকালবোধন’ বিষয়টির কোন উল্লেখ নেই। তবে কৃত্তিবাসী রামায়ণে অকালবোধনের সুন্দর ও বিস্তৃত বর্ণনা পাওয়া যায়। একশ আটটি নীলপদ্ম দিয়ে রামচন্দ্র দুর্গাকে পূজা করে তাকে সন্তুষ্ট করে রাবণবধ করেন। রামায়ণের এই আখ্যানকে গল্পকথা বলে তুচ্ছ করা যাবে না। কারণ মহাভাগবতম্ নামক শাক্ত উপপুরাণের পঁয়ত্রিশতম অধ্যায়ে রামচন্দ্রের অকালবোধনের সমর্থনে বিবরণ পাওয়া যায়।
“অকালে বার্ষিকীং পূজাং যাং চকার রঘুদ্বহঃ
রাবণস্য বধার্থায় ভক্ত্যা পরময়া যুতঃ॥”
কালিকাপুরাণ ও বৃহদ্ধর্মপুরাণেও অকালবোধনের বিবরণ আছে। তবে সেখানে রামচন্দ্র স্বয়ং অকালবোধন করেননি। তাকে অনুগ্রহ করে ব্রহ্মা রাত্রিকালে দেবীকে বোধিত করেছিলেন, আজকালকার দিনের পূজা পদ্ধতিগুলোতে সেই আখ্যান স্মরণ করে ঐ মন্ত্রপাঠের বিধান পরিলক্ষিত হয়। বোধনে পাঠ্যমন্ত্রটি হলো:
“শত্রে“ণ সংবোধ্য স্বরাজ্যমাপ্তং তষ্মাদহং তাংপ্রতিবোধযামি
যথৈব রামেণ হতো দশাস্যস্তথৈব শত্র“ণ্ বিনিপাতয়ামি ॥”
অর্থাৎ ইন্দ্র যেমন আপনাকে প্রলুব্ধ করে পূজা করার জন্য স্বরাজ্য লাভ করেছিলেন, আমিও তেমনি রাজ্য লাভের জন্য আপনার বোধন করেছি। রাম যেমনভাবে আপনার পূজা করে দশমুণ্ড রাবণকে নিহত করেছিলেন, আমিও সেভাবে যেন শত্র“দের বিনাশ করতে পারি।
রামচন্দ্রের এই পূজাকে অকালবোধন বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে শরৎ ঋতুকে কখনই দেবীপূজার ক্ষেত্রে ‘অকাল’ বলা যায় না। কারণ শরৎবিষুববিন্দুতে যেমন শারদীয়া পূজা হয, তেমনি অপর এক বিষুববিন্দুতে বসন্তকালে হয় বাসন্তীপূজা। বছরের দুটি বিষুববিন্দুতে এই দুই দেবীপূজা স্মরণ করিয়ে দেয় যে, দেবীপূজার মধ্যে জ্যোতিষতত্ত্বের বিশেষ এক লুপ্ত অধ্যায় নিহিত আছে। মর্কেণ্ডেয় চণ্ডীতে শরৎকালে যে দুর্গাপূজার বিধান, সেখানে শরৎকালে দেবীপূজার যথার্থকালই বলা হয়েছে।
এই শরৎকালেই এখনও পর্যন্ত বাংলার ঘরে ঘরে অনুষ্ঠিত হয় ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত পাঁচদিনের দুর্গোৎসব। মানবসভ্যতা ও কৃষ্টির মেলবন্ধনের এক অপরূপ মিলন উৎসব এই দুর্গাপূজা। তৃণে তৃণে শিশিরবিন্দু, উজ্জ্বল সূর্যের কিরণ, শিউলির ঘ্রাণ আর কাশের দোলায় প্রকৃতিও দেবীর আরাধনায় মত্ত হয়ে ওঠে। মহালয়ার পিতৃপক্ষের তিলাঞ্জলি তর্পণান্তে হয় দেবীপক্ষের সূচনা। সৌর আশ্বিনের কৃষ্ণপক্ষের নাম ‘মহালয়’। ‘মহলয়’ শব্দ তেকেই মহালয়ার উদ্ভব। দেবীপক্ষের বোধনমন্ত্রে মঙ্গলময়ী করুণাময়ীর আবাহনে দিগ্দিগন্ত হয় মুখরিত। ষষ্ঠী তিথিতে দুর্গার বোধন, সপ্তমীতে মূর্তির প্রাণ প্রতিষ্ঠা, অষ্টমী ও নবমীতে মহাপূজা ও দশমীতে দেবীর বিসর্জন। এই পূজার একটি বিশেষত্ব হলো সন্ধিপূজা। অষ্টমী নবমী তিথির মিলনক্ষণে সন্ধিপূজা। এর সময়সীমা আটচল্লিশ মিনিট। অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিক্ষণে রামচন্দ্র রাবণের দশটি মুণ্ড ছিন্ন করেছিলেন। তাই এই সময়ে পূজার মাহাত্ম্য বেশি। শুধু তাই নয়, সন্ধিপূজার বলির রক্ত যেন নববর্ষের নতুন সূর্যালোকের প্রতীক। বলির তাৎপর্য হলো পশুপ্রকৃতিকে দেবীর চরণে নিবেদন। ছাগ হলো কামের প্রতীক। মেঘ মোহের প্রতীক। মহিষ ক্রোধের প্রতীক। চালকুমড়া মাংসের প্রতীক এবং আখ মদ্যের প্রতীক।
শ্রী শ্রী চণ্ডীতে মার অভয়বাণী:
“ইযুং সদা সদা বাধা দানবোত্থা ভবিষ্যতি।
তদা তদাবতীর্যাহং করিষ্যামারিসং ক্ষয়ম ॥”
অর্থাৎ যখনি দানবের প্রাদুর্ভাবের জন্য সমূহবিঘœ আসবে, তখনি আমি আবির্ভূতা হয়ে শত্র“দের বিনাশ করবে।
শ্রী শ্রী চণ্ডীতে আছে, মেধস মুনির আশ্রমে মুনির কাছে শ্রী শ্রী চণ্ডীর মাহাত্ম্য শুনে ২য় মনু স্বারোচিষের পুত্র চৈত্রের বংশে উৎপন্ন রাজা সুরথ ও বৈশ্য সমাধি নিকটস্থ নদীতীরে মৃন্ময়ী মূর্তির ৩ বছর পূজা করে দুর্গার আশীর্বাদ লাভ করেন। তন্ত্রে দুর্গাকে ভয় ও শত্র“নাশিনী বলা হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে, প্রতি শক্তির দুটি রূপ থাকে। শিবপত্নীরও তেমনি দুটি প্রকৃতি: উমা ও গৌরী। শিবের নম্র শক্তি আর দুর্গা আর কালী রুদ্র শক্তি।
দুর্গার ক্ষেত্রেও তন্ত্র বলেছে:
দ হচ্ছে দৈত্যনাশসূচক, উ বিঘœনাশসূচক, র রোগনাশসূচক, গ্ পাপনাশসূচক, ভয় ও শত্র“বিনাশসূচক অর্থাৎ এখানে দুর্গার সংহারমূর্তিই কল্পিত।
এছাড়া মা’র আগমনী গানের পিছনেও আছে, কিন্তু সকলের জন্য কল্যাণী মারের সোহাগ কামনা। অসুরের বিনাশে যেমন আসে শান্তিপূর্ণ নতুন জীবন, তেমনি দুঃখ দূর হলেই আসবে সুখ, অত্যচারী বিনষ্ট হলেই আসবে কল্যাণ, দুর্ভিক্ষ দূর হলেই আসবে ক্ষুধার অন্ন, অন্ধকার দূর হলেই আসবে আলোর উদ্ভাস। আগমনির পুণ্যলগ্নে, পুণ্য আগমনী গানে এই প্রতিজ্ঞার সূরই ধ্বনিত হয় যে, বাঙালি শুধু নিজের জন্য নয়, সকল মানুষের জন্য সুখ-শান্তি ও আশীর্বাদ প্রার্থনা করে।
রবীন্দ্রনাথের ভাষায়:
“মাতৃহারা মা যদি না পায় তবে কিসের উৎসব?
দ্বারে যদি থাকে দাঁড়াইয়া ম্লান মুখ বিষাদে বিরস,
তবে মিছে সহকার শাখা তবে মিছে মঙ্গল কলস।”
বাঙালির এই ভাবনার মধ্যে কল্লোলিত হচ্ছে শ্রী শ্রী চণ্ডীতে মা দুর্গার কাছে দেবতাদের প্রার্থনা:
“প্রণতানাং প্রসীদ তং দেবী বিশ্বার্তিহারিণী।
ত্রৈলোকৎবাসীনামীজে লোকানাং বরদা ভব।”
সকল প্রাণীর কল্যাণ কামনাই বাঙালির আগমনির ভাবনায় পরিলক্ষিত হয়।
লেখক- পণ্ডিত তরুণ কুমার আচার্য কৃষ্ণ
উপাধ্যক্ষ, সূর্যগিরি আশ্রম