শামীম শিকদার
খুব রেগেই বাসা থেকে বের হলাম এতোটাই রেগেছিলাম যে পুরোনো জমা কাপড় পড়েই চলে এসেছি। খুব রাগ হচ্ছে মার উপর টাকা দিতে পারবে না তবে ছেলেকে কলেজে পড়ানোর এতো শখ কেন? প্রতিদিন কলেজে যাওয়ার সময়ই ছোট খাটো একটা ঝগড়া করতে হয় সামান্য কিছু টাকা নিয়ে। ১০ টাকা কলেজে যাওয়ার বাস ভাড়া ২০ টাকা দিয়েই বলে বাবা আজ আর টাকা নেই। তখনই আমার রাগটা বিগড়ে যায় শুধু বাস ভাড়া নিয়ে কি কলেজে যাওয়া যায়? তাই প্রায় সময়ই কলেজে যাওয়া হয়না। আজকে ঠিক এমনই একটি ঘটনা ঘটেছিল সকাল সকাল সামান্য কিছু টাকার জন্য মেজাজটা বিগড়ে গেল। কি দরকার ছিল, টাকাটা দিয়ে দিলেই পারত, এমন কিছু ভেবে ভেবেই রাস্তা দিয়ে হাটছি। বাস স্ট্যেন্ডে এসে বসলাম, বাসে উঠব। আর মনে মনে মার উপর খুব রাগ হচ্ছে। টিকেট নিয়ে বাসে উঠে বসলাম, অনেকটা শীত শীত অনুভব হল কিন্তু কিছু করার নেই কারণ সাথে কোন শীতের কাপড় নেই। বাসের জানালাটা বন্ধ করে দিলাম, সাথে বসেছিল এক ভদ্রলোক, আড়চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। বাস সামনের স্টপিজে থামা মাত্রই বাসে উঠল মধ্য বয়সের একটি মেয়ে। শরীটা প্রায় ভিজা কারণ বাহিরে অবিরত রিমঝিম বৃষ্টি পড়ছে। মেয়েটি আমার দিকেই এগিয়ে আসছে, আমি এমনটাই অনুভব করতে পারলাম। পাশে এসেই বলল আপনি একটু উছে দাঁড়াবেন, প্লিজ! আমি অনেকটা অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম, কেন দাঁড়াব? মেয়েটি উত্তরে বলল একটি মেয়ে মানুষ দাঁড়িয়ে আছে বসতে দিবেন না? এমনিতেই মেজাজটা গরম মেয়ের কথা শুনে আরো গরম হয়ে গেল। আমি বললাম মেয়ে হয়েছেন তো পুরো পৃথিবীটাই কামাই করে ফেলেছেন। মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম, মেয়েটি লজ্জিত বোধ করছে। অবশেষে আমার সিটে মেয়েটিকে বসতে দিলাম। আমি সিটের পাশেই দাঁড়িয়ে আছি মানুষের ধাক্কা ধাক্কিতে অতৃক্ত বোধ হচ্ছে। প্রতিদিন বাসে করেই কলেজে যাই কিন্তু কোন দিনই এমন মনে হয়না কিন্তু আজকে অতিরিক্ত রাগের কারণে ভাল কথা গুলোও মন্দ মনে হচ্ছে। ভিজা জামা কাপড়েই এক পুরোনো বন্ধুর বাসায় উঠলাম। পুরোনো বলতে আমার স্কুল জীবনের বন্ধু জাহিদ। স্কুলে আমাদের দুজনের খুব ভাল বন্ধুত্ব ছিল। কিন্তু কলেজে দুজন আলাদা হয়ে গেলেও বন্ধুত্ব আলাদা হয়নি। প্রায় সময়ই ওর সাথে ফোনে কথা হয় বাসায় আসতে বলে তাই আজ অনেকটা অজুহাত ধরেই চলে এসেছি। কিন্তু বাসায় এসে দেখি জাহিদ নেই মামার বাড়িতে বেড়াতে গেছে। কোন উপায় না পেয়ে রুমের ভিতরেই বসলাম, ভিজা কাপড় গুলো শুকাচ্ছে। কিন্তু জাহিদকে ছাড়া কতক্ষন বসে থাকা যায় বাধ্য হয়ে চা বিস্কুট খেয়ে বের হয়ে পড়লাম ইয়াসিনের বাড়ির উদ্যেশে। টিকেট ছাড়াই একটি লোকাল বাসে উঠে বসলাম কারণ পকেটে টাকা একেবারেই কম। বৃষ্টিটা অনেকটা থেমেছে কিন্তু আমার কাপড় পুরো ভিজা, ঠান্ডা ঠান্ডা অনুভব হচ্ছে। বসে বসাতে বাসের সিটটাও ভিজে যাচ্ছে। আজ কলেজে যাওয়া হয়নি কেবল মার উপর রাগ করেই। তবে যেহেতু টাকার জন্য কলেজে যেতে পারিনি তাই আর বাসায় যাব না এমনটাই মনে মনে আমার ইচ্ছা। বাস থেকেই রাস্তায় দেখতে পেলাম কতো গুলো ছেলে রাস্তার পাশে দাড়িয়ে আছে, বয়স ৮-১০ বছরের মতো হবে পড়নে ছেড়া নোংরা জামা কাপড়, হাতে কতো গুলো পত্রিকা। বাস থামতেই ঐ সব ছেলেদের মধ্য থেকে একটি ছেলে আমাদের বাসের দিকে এগিয়ে আসছে হাতে পত্রিকাগুলো। এই খবর নিন…. খবর নিন…. তাজা খবর…. বাংলাদেশ প্রতিদিন ৫ টাকা, প্রথম আলো ১০ টাকা, এমন ভাবেই চিৎকার করছে। ছেলেটিকে দেখে আমার খুব শৈববের কথা মনে পড়ছে যে সময় আমরা এ বাড়ি ও বাড়ি ঘুরে বেড়াতাম বাবার পকেট থেকে টাকা চুরি করে নিয়ে কিনতাম নানান ধরনের চকলেট, হাতে থাকত বাহারি রঙ্গের খেলনা। কিন্তু এ কেমন মায়ের সন্তান যার হাতে আজ পত্রিকা। যে হাতে থাকার কথা ছিল খেলনা ও খাতা কলম, মুখে থাকার কথা ছিল পৃথিবীর সবচাইতে প্রিয় ডাক বাবা-মা। অনেক ইচ্ছা হল ছেলেটির সম্পর্কে জানতে তাই ছেলেটিকে ডাক দিয়ে আমার পাশের সিটে বসিয়ে নাম জানতে চাইলাম। কিন্তু ছেলেটি চট করে বলে ফেলল সাহেব আমি ’বইতাম না, কি কইবেন তা কইন আমার পেপার বেচার লাগব’। আমার পকেটে তেমন টাকা নেই তবু পকেট থেকে কিছু হাতে দিয়ে তার সর্ম্পকে জানতে চাইলাম। কিন্তু যা শুনলাম তাতে এক শ্রেনীর মানুষ নামে কথিত প্রানীর উপর জন্মালো ঘৃনা। ছেলেটির বয়স যখন পাঁচ বছর তখন তার মা তাকে রেখে চলে যায় তার পর থেকে পাওয়া না পাওয়ার মাঝে বাবার কাছেই বেড়ে উঠা। কখনো অনাহারে কখনো অর্ধঅনাহারে কাটে তার দৈনন্দিন জীবন। বাবা একজন হকার এ শহরেই অলিতে- গলিতে ঘুরে হকারি করে, কখনও পুলিশের, কখনও চাঁদাবাজীর সম্মুখে জুটে না তাদের চাহিদা মত খাদ্য। তাই আজ এই ৮-১০ বছরের ছেলেটি হকার। শুধু পেট ভরে তিন বেলা খাওয়ার জন্য এ ছেলেটির হাতে আজ পত্রিকা। যেখানে নেই কোন মায়ের খুঁজ নেই বাবার আদর।
রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে ছেলেটি বিক্রি করে পত্রিকা। কিন্তু আমি কয়েকটি টাকার জন্য আমার মার সাথে ঝগড়া করে চলে এসেছি ভাবতেই নিজের উপর ঘৃনা হচ্ছে। ইয়াসিনের বাসায় আর যাওয়া হল না ভিজা কাপড় নিয়েই প্রায় সন্ধ্যার দিকে আমাদের বাড়িতে চলে আসলাম। রুমের ভিতরে লাইট জ্বলছে বাবা বাসায় নেই, জানি কারণ বাবা অফিস থেকে বাসায় ফিরে প্রতিদিন রাত ১০ টার পর। অনেকটা চোরের মত করেই রুমের ভিতরে ডুকলাম। মা রুমের ভিতরে এক কোন বসে বসে কাঁদছে, আমারও মাকে দেখে অনেকটা চোখো পানি চলে আসছে, অনেক কষ্টে আটকে রাখলাম। আমার মত মা কি রাগে কাদছে না কি কষ্টে? মার কাছে আমার ভুল স্বীকার করে নিলাম। মা আমি বুঝতে পারি নি, আমাদের থেকেও কষ্টে মানুষ জীবনযাপন করছে। মুখে এক মুঠো খাদ্য দেওয়ার জন্য সারাদিন পরিশ্রম করে। তুমি তো আমাকে অনেক আদর কর, অনেক বেশি ভালবাস, মার কান্নাটা ভেরে গেল, মা আমাকে জরিয়ে ধরল আমিও কাদতে শুরু করলাম। মা হচ্ছে আমাদের ব্যাংক যেখানে আমরা সকল দুঃখ কষ্ট অনুভূতি গুলো জমা রাখতে পারি। মা এমন একটি ব্যাংক যার কাছে ৩০ টাকা জমা দিলে তিন ত্রিশে নব্বই টাকা নেওয়ার পরও বলি ও মা, তোমার কাছে তো ত্রিশ টাকা পাই মনে আছে? কখন দিবা? মায়ের সরল উত্তর হ,মা মনে আছে, তুমি ওই ৩০ টাকা নব্বই বার নিলেও আজীবন আমার কাছে টাকা পাওনাই থাকবা। ইহ জীবন তোমার পাওনা আমি মিটাতে পারব না। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ উপহার হলো মা, ভালবাসা মাপার জন্য বিজ্ঞানীরা এই পর্যন্ত কোন মাপ কাঠি বানাতে পারেনি যদি পারত তাহলে সেখানে প্রথম স্থান থাকত মা নামের নি:স্বর্থ মহিলাটির। মা আমি আর তোমাকে কষ্ট দিব না তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও। বাবা, মা কখনো কি সন্তানের উপর রাগ করে থাকতে পারে। তাইতো তোমার নাম পৃথিবীর শ্রেষ্ট নাম, মা। তোমার আঁচলে যে ভালবাসা লুকিয়ে আছে তা পৃথিবীর অন্য কোথায়ও নেই মা।
লেখক- গাজীপুর, ঢাকা।