মুহাম্মদ শহীদুল ইসলাম
“সেলফি”-আজকালকার দিনে সবথেকে বেশি ব্যবহৃত শব্দ। রোজকার জীবনে এখন একটা বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে সেলফি। সিনেমা দেখতে যাওয়া হোক বা কলেজের মাঠে কিংবা অন্য কোন আড্ডা, মানুষ এখন ভীষণভাবে সেলফি সচেতন। কোনও কাজ করার আগেই ভেবে নেয় সেলফির পোজটা কী হবে। কোন পোজে সেলফি তুললে বন্ধুরা বেশি পছন্দ করবে, ফেসবুকে লাইক পড়বে বেশি। জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে ক্রমে ছড়িয়ে পড়ছে সেলফি ফিভার। কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না এই সেলফি নিয়ে রয়েছে একটি ইতিহাস এবং একি সাথে মজার ও দুঃখজনক ঘটনা।
পৃথিবীর প্রথম সেলফি: পৃথিবীর প্রথম সেলফির বয়স ১৭৫ বছর। ১৮৩৯ সাল। যখন স্মার্টফোন ছিল না, ক্যামেরায় ছিল না ফ্রন্ট ক্যামেরা, প্রাইমারি ক্যামেরার বিভেদ। ক্যামেরা বলতে যা বোঝায় সেই ক্যামেরা দিয়েই উঠেছিল পৃথিবীর প্রথম সেলফি। সেলফিটি তুলেছেন। ডিলাডেলফিয়ার এক কেমিস্ট রবার্ট কর্নেলিয়াস। পেশায় কেমিস্ট হলেও তার রসায়ণটা ছিল ছবির সঙ্গে। ছবি তোলা নিয়ে নানা রকম পরীক্ষ-নিরীক্ষা করতে করতে হঠাৎই তার মাথায় আসে নিজের ছবি নিজে তোলার কথা। বাড়ীর দোকানটার পিছনের দিকে বসান ক্যামেরা। লেন্সের ঢাকনা সরিয়ে ছবি ক্যাপচার করে সঙ্গে সঙ্গে ঢুকে পড়েন ফ্রেমে। ১মিনিট পোজ দেন। তারপর আবার ঢেকে দেন লেন্স। তৈরি হয় বিশ্বের প্রথম সেলফি। ছবিটির নীচে রবার্ট কনেলিয়াস লিখেছেন The first light picture ever taken. 1839৯’। অনেকে মনে করেন, প্রথম সেলফি তোলা হয় ১৯২০ সালের ডিসেম্বর মাসে নিউইয়র্ক সিটির একটি বাড়ীর ছাদে।
সেলফিতে মৃত্যু: সেলফি তুলতে গিয়ে পৃথিবীতে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে লেবাননে। আর এখন সেলফি তুলতে গিয়ে যতজন মারা যান, তার প্রায় অর্ধেক ঘটনাই ভারতের।এক পরিসংখ্যান বলছে, শুধু ভারতেই গত দুই বছরে পঞ্চাশটিরও বেশি মৃত্যুর কারণ সেলফি। সেলফি তোলার হিড়িক আটকাতে মুম্বাই পুলিশ শহরের ১৬টি জায়গাকে ‘নো সেলফি জোন’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে, যেখানে সেলফি তোলা নিষিদ্ধ। এছাড়া আমাদের দেশসহ বিভিন্ন দেশে চলন্ত ট্রেনের সাথে সেলফি তুলতে গিয়ে মৃত্যু, সমুদ্রের তীরে ব্রীজে দাঁড়িয়ে সেলফি তুলতে গিয়ে মৃত্যু, রিভলবার হাতে সেলফি তুলতে গিয়ে নিজের গুলিতে মৃত্যু, বাঘের সাথে সেলফি তুলতে গিয়ে বাঘের থাবায় মৃত্যু এবং সাপের সাথে সেলফি তুলতে গিয়ে সাপের ছোবল খাওয়া ইত্যাদি ঘটনা অহরহ ঘটছে।
পৃথিবীর ভয়ঙ্কর ও অমানিবক সেলফি: ডেইলি মিরের খবর, প্রেমিকাকে খুন করে সেলফি তুলেছে এক পাগল প্রেমিক। ওই প্রেমিকের নাম কিউইন। তিনি চীনা নাগরিক। প্রেমিকার সেলফি পছন্দ না হওয়ায় তাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেন ওই পাগল প্রেমিক।
ধর্ষিতা মহিলার সাথে দেখা করতে গিয়ে তার সাথে সেলফি তুলে অমানিবক আচরণ করেছেন ভারতের রাজস্থানের মহিলা কমিশনের এক সদস্য সোম্য গুর্জর।
২০১৫ সালের ঘটনা। মৃত নানার সাথে সেলফি তুলেছেন তার তিন নাতি। সেখানে দেখা যায়, মৃত নানা শুয়ে আছেন হাসপাতালের ট্রলিতে, তাকে ঘিরেই তার তিন নাতি সেলফি তুলেছেন হাসিমুখে।
নাতি তার দাদার লাশের সাথে নিয়েছেন সেলফি আর ক্যাপশনে লিখেছেন ‘আমার দাদা এইমাত্র পরকালে চলে গেলেন।’
মৃত বোনকে কবর দেয়ার সময় ভাইদের হাস্যোজ্জল সেলফি সারা বিশ্বে সমালোচনার ঝড় তুলেছেন কিছুদিন আগেই।
হাস্যকর সেলফি: পলাতক আসামী নিজেই তার একটা সেলফি পুলিশের ফেসবুক পেজে মেসেজ করে পাঠায় এবং লিখে ‘এখানে একটা ভালো ছবি দিলাম, আগের ছবিটা জঘন্য। পরে পুলিশ কর্মকর্তারা অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে আসামির পাঠানো সেলফিটি আপলোড করে নেন।
গত রমজানে তারাবির নামাজে সেজদারত এক মেয়ের সেলফি রীতিমত হাসরস্যের সৃষ্টি করেছে। দেখা যাচ্ছে, মেয়েটি সিজদায় গেছেন আর এক হাত সামনের দিকে নিয়ে নিজের সিজদার সেলফি তুলছেন।
হজ্ব করতে গিয়ে কাবা ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে সেলফি তুলে আপলোড দিয়েছেন এক ব্যক্তি আর ক্যাপশনে লিখেছেন-`its imagine i’m LOLO’
সেলফিতে নারীদের খরচ ৬ কোটি পাউন্ড: শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও বিশ্বে প্রতিবছর সেলফি তুলতে নারীদের মেকআপের ব্যয় প্রায় ৬ কোটি পাউন্ড। নারীরা সেলফিতে নিজেদের নিখুঁত দেখাতে সচেষ্ট থাকেন সব সময়। কসমেটিক্স সামগ্রী ব্যবহার করেই তা করে থাকেন নারীরা। আর এতেই ব্যয় হয় এত বড় বাজেট।
সেলফি নিয়ে আরও তথ্য : ১. ২০১৩ সালের নভেম্বর মাসে ‘সেলফি’ শব্দটিকে বছরের সেরা শব্দ বলে স্বীকৃতি দেয় অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারি। ২. কীভাবে ভাল সেলফি তোলা যায় সেটা জানতে প্রচুর মানুষ প্রতিদিন অনলাইনে খোঁজ করেন। ৩. সীমক্ষা বলছে, ১৯৮০ সালের পরে যাদের জন্ম তারা গোট জীবনে ২৫ হাজার সেলফি তুলবেন। ৪. বহু মানুষ বছরে ৫৪ ঘন্টা অর্থাৎ দু’দিনেরও বেশি সময় সেলফি তুলে খরচ করেন। ৫. ব্রিটেনের একটি ক্যান্সার রিসার্চ সংস্থা ২০১৪ সালে মেকআপ ছাড়া সেলফি তোলার প্রচারাভিযান চালায়। ৬. ‘বেটা বাঁচাও, বেটি পড়াও’ অভিযানের অংশ হিসেবে ২০১৫ সালে ভারতীয় পুরুষদের মেয়ের সঙ্গে সেলফি তুলে টুইটারে পোস্ট করার ডাক দেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ৭. ২০১৪ সালের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রতিদিন বিশ্বে ১০ লাখ সেলফি তোলা হয়। ৮. সবচেয়ে বেশি সেলফি পোস্ট করা হয় ফেসবুকে।
সেলফি একটি রোগ: বর্তমানে সময়ে সেলফি একটি ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। বেশি বেশি সেলফি তুললে একটি রোগের ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে বলে সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞরা। রোগটির নাম ‘সেলফি এলবো’।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সেলফি এলবো সমস্যাটি একবার দেখা দিলে তা ধীরে ধীরে এমন অবস্থায় পোঁছায়, যাতে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। এ সমস্যা হলে যে হাতে সেলফি তোলা হয়, সে হাতের কনুইয়ে ব্যাথা অনুভব হতে থাকে।
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় জানা গেছে, সেলফি তোলার সময় হাই এনার্জি ডিজিবল লাইটের প্রভাবে ত্বকের ডিএনএ ড্যামেজ থেকে শুরু করে ক্যান্সারের মত মারাত্মক অসুখের সম্ভাবনা প্রবল। হতে পারে মনের সমস্যাও। সাবধান করলেন ভারতের ত্বক বিশেষজ্ঞ ডাঃ সন্দীপন ধর ও মনোবিদ দেবাশিস রায়।
আমেরিকান একাডেমি অফ ডার্মাটোলজিতে সাম্প্রতিক এই বিষয়ে এক গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। জানা গেছে, যে ব্লু ব্যান্ডের হাই এনার্জি ভিজিবিল লাইট ত্বক ও চোখের মারাত্মক ক্ষতি করে। ফলস্বরূপ শুরুতে কম বয়সে ত্বক বুড়িয়ে যেতে শুরু করে। আর দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি আরও মারাত্মক।
সেলফি তোলা শুধু যে শরীরের ক্ষতি করে তাই নয়, মানসিকভাবেও অসুস্থ করে তোলে। সেলফি তুলতে গিয়ে অনেকেরই এমন অবস্থা হয় যে, কাজকর্ম, খাওয়া, ঘুমসহ নিজের রোজকার স্বাভাবিক জীবন যাপন পর্যন্ত ব্যহত হয়। অনেকে আবার যেখানে সেখান, যখন তখন হাস্যকরভাবে সেলফি তুলতে শুরু করে। আমেরিকান সাইক্রিয়টিক এসোসিয়েশনের বিশেষজ্ঞদের মতে, বেশি বেশি কিংবা সারাদিন ধরে সেলফি তোলা পারসোনালিটি ডিজঅর্ডারের লক্ষণ। এটি একটি মানসিক রোগ। রোগটির নাম ‘সেলফাইটিজ’।
পরিশিষ্ট: সেলফির বিষয়টি এত বেশি বাড়াবাড়ির পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, অনেকেই ইতোমধ্যে এটি নিয়ে ভাবতে শুরু করেছেন। সেলফি থেকে বিরত রাখতে বিশেষ করে যুব সমাজকে এ থেকে মুক্ত করতে অনেক গবেষণা এরিমধ্যে হয়ে গেছে। আমি মনে করি, শুধু গবেষণা আর আলোচনা করলেই হবে না; এ ব্যাপারে অভিভাক, ফ্যামিলি ও সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ এবং সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। সর্বোপরি নিজের সচেতনতাই পারে এ রোগ থেকে মুক্তি দিতে।