আজ : শনিবার ║ ১৫ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

আজ : শনিবার ║ ১৫ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ║২রা ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ║ ১৬ই শাবান, ১৪৪৬ হিজরি

দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম বুঝতে হবে

ডা. মো. জামাল উদ্দিন

দাঁত মেরুদণ্ডী প্রাণীদের মুখে অবস্থিত একটি অঙ্গ। এটি খাদ্য চর্বণ ও কর্তনের (কাটা) কাজে ব্যবহৃত হয়। অধিকাংশ প্রাণীর দেহে দাঁতই হচ্ছে কঠিনতম অঙ্গ। মুখের সুস্থতা অনেকাংশেই মুখ পরিষ্কার রাখা সংক্রান্ত নিয়মিত চর্চার উপর নির্ভর করে। মুখ পরিষ্কার রাখার ফলে দাঁতের ক্ষয়রোগ, জিংজিভিটিজ, পেরিওডন্টাল রোগ, হ্যালিটোসিস বা মুখের দুর্গন্ধ এবং অন্যান্য দন্তজনিত সমস্যা থেকে ব্যক্তি রক্ষা পায়। পেশাদারী এবং ব্যক্তিগত-উভয় পর্যায়েই এ ধরণের সচেতনতা প্রয়োজন। সচেতনভাবে দাঁত ব্রাশ করার পাশাপাশি নিয়মিত দন্তচিকিৎসকের মাধ্যমে দাঁত পরিষ্কার করলে দাঁতের ক্যালকুলাস বা টারটার এবং দাঁতে অবস্থানরত ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া দূরীভূত হয়। পেশাদারীভাবে দাঁতের পরিষ্কারের জন্য টুথ স্কেলিং করা হয়। এ পর্যায়ে বিভিন্ন ধরণের যন্ত্রপাতির প্রয়োগ দেখা যায়। দাঁতের প্রকারভেদ: (ক) মোলার বা সাদা বাংলায় “কষ দাঁত”: এটি খাদ্যকে চিবিয়ে পিষে ফেলার কাজে ব্যবহৃত হয়। (খ) কার্নাসিয়াল দাঁত ব্যবহৃত হয় খাদ্য কর্তনের কাজে। এটি কেবল শ্বাপদ (মাংসাশী) প্রাণীদের মধ্যে দেখা যায়। (গ) প্রি-মোলার দাঁত মোলার দাঁতের মতই, কিন্তু আকারে ছোট, এবং অনেক সময় এদেরকে বাইকাস্পিডও বলা হয়। (ঘ) শ্বদন্ত বা ক্যানাইন খাদ্য ছিঁড়ে ফেলার কাজে ব্যবহৃত হয়। একে কাস্পিড দাঁতও বলা হয়ে থাকে। (ঙ) ছেদক দন্ত বা ইন্সিসর খাদ্য ছেদনের কাজে ব্যবহৃত হয়। মানবদেহের দাঁতের লম্বচ্ছেদে বিভিন্ন অংশ দেখানো হয়েছে।

(ক) ক্রাউন বা মুকুট: এটি দাঁতের সেই অংশ যা মাড়ির ওপরে থাকে এবং আমরা দেখতে পাই। (খ) রুট বা শিকড়: এটি দাঁতের সেই অংশ যা মাড়ি এবং হাড় দিয়ে আবৃত থাকে। দাঁতের শিকড়ের সংখ্যা এক থেকে চার পর্যন্ত হয়ে থাকে। (গ) দাঁতের মুকুট ও শিকড়ের সংযোগস্থলকে নেক (Neck) বলা হয়। এটিও সাধারণত মাড়ি দিয়ে আবৃত থাকে। দাঁতে উপস্থিত কলাসমূহ: (ক) এনামেল: এটি দাঁতের বাইরের শক্ত আবরণ, যা ক্যালসিয়াম ও ফসফেট দ্বারা গঠিত। (খ) ডেন্টিন এটি ভিতরের স্তর, যা দাঁতের অধিকাংশ স্থান জুড়ে বিদ্যমান। (গ) দন্তমজ্জা (ডেন্টাল পাল্প) এটি দাঁতের ভিতরের অংশ। এখানে স্নায়ু ও রক্তবাহী নালিকা বিদ্যমান। (ঘ) সিমেন্ট এটি দাঁতের মূলের চারিদিকে অবস্থিত পাতলা স্তর। এটি এক ধরনের অস্থিসদৃশ আবরণ, যা দাঁতকে চোয়ালের সাথে সংযুক্ত করে রাখে। এছাড়াও, দাঁতের সিমেন্ট ও চোয়ালের মাঝখানে যে সূক্ষ্ম ফাঁকা থাকে, সেখানে অগণিত অতিসূক্ষ্ম তন্তুসদৃশ লিগামেন্ট থাকে যাকে পেরিওডন্টাল টিস্যু বলে। দাঁতকে হাড়ের সাথে সংযুক্ত রাখাই এর প্রধান কাজ। দাঁত পরিষ্কার রাখার উদ্দেশ্যই হচ্ছে দাঁতের আবরণে ও ফাঁকা জায়গায় অবস্থানরত ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াকে দূরে রাখা। দন্ত্যচিকিৎসা মুলত মুখগহ্বর সম্পর্কিত বিষয়গুলো নিয়ে চর্চা করে। অন্যান্য আর্থ-সামাজিক গোষ্ঠির তুলনায় সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য মুখগহ্বরের রোগগুলোই গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা কারণ হল এর অধিকতর ব্যাপ্তি এবং বিশ্ব জোড়া প্রাদুর্ভাব। দাঁতের বেশিরভাগ চিকিৎসা করা হয় দুইটি অত্যন্ত প্রচলিত মৌখিক রোগের প্রতিরোধ বা প্রতিকারের জন্য এগুলো হল দাঁতের ক্ষয়রোগ আর মাড়ির অসুখ বা পায়েরিয়া। সাধারণ চিকিৎসাগুলো হল দাঁতের পুনঃপ্রতিষ্ঠা, উৎপাটন বা দাঁতের অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে অপসারণ, দাঁত স্কেলিং অথবা রুট ক্যানাল। চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুসারে দাঁতের যত্নের প্রায় পুরোটাই নিজেদের হাতে। আর যত্ন আত্তির ব্যাপারটা ঘরের ভেতরই সারতে হয়। দাঁতের যত্ন বিশেষ কোর্স কিংবা স্পেশালিস্টের দ্বারস্থ হতে হয় না। কেবল বাড়িতে বসে নিয়মমাফিক দাঁতের কিছু যত্ন আত্তি করলেই দাঁত ভালো রাখা যায়। তবে কারও দাঁতে সমস্যা দেখা গেলে ভিন্ন কথা। তখন তো ডাক্তারের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। তবে আমাদের একটু সচেতনতাই ডাক্তারের কাছে যাওয়ার হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারে। নিয়মিত দাঁত ব্রাশ করার পাশাপাশি দাঁতের যত্নে প্রধান করণীয় হচ্ছে দাঁতের প্লাক পরিষ্কার করে রাখা। প্লাক হল এক ধরনের স্বচ্ছ ব্যাকটেরিয়া লেয়ার, যা দাঁতের উপরে লেগে থেকে দাঁতের ক্ষতি সাধন করে থাকে। এই প্লাক পরিষ্কার করার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো দিনে অন্তত দুবার দাঁত মাজা এবং একবার মাউথ ওয়াশ ব্যবহার করা। মনে রাখতে হবে দাঁতের সঙ্গে মাড়ির সংযোগস্থলটিকে সচল ও সুস্থ রাখার জন্য দাঁত মাজার কোনো বিকল্প নেই। স্বাস্থ্যপরিচর্যা বিষয়ক ব্যক্তিত্ব হিসেবে দন্তচিকিৎসকগণ পরামর্শ দেন যে, (ক) প্রতিদিন খাদ্য গ্রহণের পর সকালে কিংবা রাতে দুবার নিয়মিতভাবে দাঁত ব্রাশ করতে হবে। এর ফলে দাঁতের গঠন সুন্দর এবং মজবুত হবে ও ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার হাত থেকে রক্ষা পাবে। (খ) প্রতি তিন মাস অন্তর টুথব্রাশ পরিবর্তন করতে হবে। সম্ভব হলে এর আগেই টুথব্রাশ পরিবর্তন করা যেতে পারে। (গ) প্রতি ছয় মাস পরপর দন্তচিকিৎসকের সুপারিশ গ্রহণ করতে হবে। (ঘ) ফ্লুরাইডযুক্ত টুথপেস্ট বা মাউথওয়াশ ব্যবহার করা উচিত, যা দাঁতকে আরো সুরক্ষা করবে। সঠিক সময়ে দাঁতের রোগ সমুহের চিকিৎসা না করালে জীবনে ঘটতে পারে ভয়াবহ বিপর্যয়। পড়তে হবে কঠিন রোগের মুখোমুখী। দাঁতের যত্নের একটু অবহেলার কারণে উল্লেখিত রোগ সমূহ বাসা বাধতে পারে। পরিপাকতন্ত্রের সমস্যা: খাদ্য পরিপাক শুরু হয় মুখে। ঠিকমতো খাবার চিবুতে বা পিষতে না পারার কারণে খাবার হজমে সমস্যা হতে পারে। দেখা দিতে পারে অপুষ্টি। মানসিক সমস্যা: আশ্চর্য হলেও সত্যি যে দাঁতের বা মুখের নানা সমস্যা থেকে মানসিক সমস্যাও হতে পারে। দীর্ঘমেয়াদি দাঁতের রোগে ভুগলে সামাজিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গর্ভকালীন জটিলতা: গবেষণায় দেখা যায়, গর্ভাবস্থায় যাঁদের মাড়ির রোগ বা মাড়ির প্রদাহ থাকে, তাঁদের গর্ভের সন্তান কম ওজন নিয়ে অথবা নির্ধারিত সময়ের আগেই জন্ম নিতে পারে। শিশুদের আচরণ ও বিকাশে সমস্যা: শৈশবকাল থেকে দাঁতের সমস্যার কারণে শিশুর বৃদ্ধিপ্রক্রিয়া ব্যাহত হতে পারে। দাঁতে ব্যথার ভয়ে শিশুরা সঠিকভাবে চিবুতে পারে না, অপুষ্টির শিকার হয়। তাদের আচরণেও সমস্যা দেখা দিতে পারে। হৃদরোগ: মাড়ির মধ্যে জমে থাকা ডেন্টাল প্লাক থেকে সৃষ্ট মাড়ির রোগের (পেরিওডন্টাল ডিজিজ) কারণে যে প্রদাহ হয়, তা রক্তের মাধ্যমে প্রবাহিত হয়ে হৃদযন্ত্রের সমস্যা তৈরি করতে পারে। মাড়ি ও দাঁতের প্রদাহ থেকে অনেক সময় এন্ডোকার্ডাইটিস, হৃদ্যন্ত্রের ভালভে প্রদাহ ইত্যাদি মারাত্মক সমস্যা হয়। মস্তিষ্ক ও ফুসফুসের রোগ: গবেষকেরা মুখের রোগের সঙ্গে মস্তিষ্কের স্মৃতিভ্রংশ বা আলঝেইমারস রোগের সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছেন। এ ছাড়া এটাও প্রমাণিত হয়েছে যে দীর্ঘদিন মাড়ির প্রদাহ থাকলে মস্তিষ্কের বোধশক্তি বা কগনিটিভ কার্যকারিতা লোপ পায়। গবেষণায় দেখা যায়, মাড়িতে প্রদাহের জীবাণুগুলো ফুসফুসেও সংক্রামিত হতে পারে এবং প্রদাহ তৈরি করতে পারে। ডায়াবেটিস: ডায়াবেটিস ও মুখের স্বাস্থ্যের সঙ্গে সম্পর্কটি হচ্ছে একটা দ্বিমুখী রাস্তার মতো। ডায়াবেটিসের কারণে মুখের প্রদাহসহ অন্যান্য সমস্যা অতিমাত্রায় বেড়ে যায়। আবার মুখের প্রদাহের কারণে রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণে রাখা মুশকিল হয়ে পড়ে। তাই দুটো চিকিৎসাই সমানতালে চালিয়ে যাওয়া জরুরি। অস্টিওপোরোসিস: অস্টিওপোরোসিস রোগ হলে হাড়ের ক্ষয় হয়। একইভাবে দাঁতের ও চোয়ালেরও ক্ষয় হয়। যদি কারও এ রোগ থাকে, তাদের দন্তক্ষয় প্রতিরোধে বাড়তি প্রতিরোধব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। সুতরাং দাঁতের সাথে জড়িয়ে আছে সুস্বাস্থ্যের আরও নানা বিষয়। আর দাঁতের যত্ন নেওয়ার বিষয়টি খুবই দরকার। আসুন দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা রক্ষা করি।

 

লেখক:  প্রাথমিক দন্ত চিকিৎসক, সভাপতি, বৃহত্তর চট্টগ্রাম ডেন্টাল এসোসিয়েশন

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

আজকের সর্বশেষ সংবাদ