দিল্লি পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশের মানুষের মনে চাপা ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে। এই ক্ষোভ যাতে ছড়িয়ে না পড়ে সেই বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন।
এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, পুরো ভারতে এনআরসি (জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন) নিয়ে যা হচ্ছে, বিশেষ করে দিল্লিতে যা হয়েছে; বাংলাদেশের মানুষের মনে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে নিয়ে একধরনের চাপা ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। এই ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়া থেকে সরকারকে সাবধান থাকতে হবে।
সম্প্রতি ভারতের রাজধানী দিল্লিতে বিক্ষোভ-সহিংসতায় ৪২ জনের মৃত্যু হয়। আহত হয় আরও তিন শতাধিক মানুষ। বিতর্কিত নাগরিকত্ব সংশোধনী (সিএএ) আইনকে কেন্দ্র করে গত রোববার থেকে দিল্লির উত্তর-পূর্বের বিভিন্ন শহরে দাঙ্গা-সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে।
এখনও থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে উত্তর-পূর্ব দিল্লির মৌজপুর, বাবরপুর, জাফরাবাদের মতো বেশ কয়েকটি এলাকায়। দিল্লির উত্তাপ পড়েছে প্রতিবেশী বাংলাদেশেও।
চলতি মাসেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে প্রধান বক্তা হয়ে বাংলাদেশে আসছেন নরেন্দ্র মোদি। তার আসন্ন এই সফর নিয়ে ইতোমধ্যে নানা প্রশ্ন উঠেছে। বহু সংগঠন তাকে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে দেয়া হবে না বলেও হুঁশিয়ার করে দিয়েছে।
এ বিষয়ে সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশে আসলে তেমন কোনো প্রতিবাদ হয়তো দেখা যাবে না। তাকে ইনসাল্ট (হেয়) করার মতো কিছু হবে না। কারণ, বাংলাদেশ সরকার তাকে অতিথি হিসেবে আনছেন। তারা সে ধরনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থাও নেবেন।’
“তবে মানুষের মনে যে চাপা ক্ষোভ তৈরি হয়েছে, তা তো থাকবেই। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারতে একধরনের ড্যাশিং, ‘বাংলা ড্যাশিং’ যাকে বলি, এনআরসি নিয়ে তা প্রতিনিয়ত ভারতে হচ্ছে। এর দায় তিনি এড়াতে পারেন না। মানুষও সেটা মনে রাখবে।”
সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্বের কথা বলা হলেও ভারতে এনআরসি নিয়ে ক্ষমতাসীন বিজিপির নেতা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কথা বলেই যাচ্ছেন। এতে দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বের সৌহার্দ্যপূর্ণ অবস্থান যা থাকার কথা, মানুষের মনের মধ্যে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।’
সাবেক এই নির্বাচন কমিশনার বলেন, ‘সম্পর্ক তৈরি হয় মানুষে মানুষে। সেই মানুষের মন তো পরিবর্তন করা যাবে না। দিল্লি পরিস্থিতি দুই দেশের মানুষের সম্পর্কে তিক্ততা বাড়াবে।’
মুজিববর্ষে মোদির আগমন প্রসঙ্গে বিশিষ্ট কূটনীতিক বিশ্লেষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘এমন একটি আয়োজনে ভারতের সরকারপ্রধানের উপস্থিত থাকাটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু মোদির আগমন নিয়ে মানুষ যেভাবে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন, তাতে সরকারের অস্বস্তি হওয়াটাও খুব স্বাভাবিক।’
‘যারা ভারতের সঙ্গে ইতিবাচক সম্পর্কে বিশ্বাসী তারাও ভারতের পরিস্থিতি এবং মোদির আগমন নিয়ে বিবৃতি দিচ্ছেন। মোটকথা, মোদির জন্য সময়টি উপযুক্ত নয়।’
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম জানায়, গত ২২ ফেব্রুয়ারি দিল্লির জাফরাবাদে সিএএ-বিরোধীরা রাস্তা অবরোধ করে। পরদিন ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে সিএএর পক্ষে ক্ষমতাসীন বিজেপির মদতপুষ্ট উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা পাল্টা সমাবেশ শুরু করে। এরপরই দুপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে। একপর্যায়ে তা সহিংসতায় রূপ নেয় এবং রণক্ষেত্রে পরিণত হয় দিল্লি।
পুলিশের সামনেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-মসজিদসহ মুসলিমদের অসংখ্য বাড়িঘর ও দোকানপাটে বেছে বেছে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। সবমিলিয়ে যেন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে দিল্লি।
বৈচিত্র্যপূর্ণ ধর্ম-বিশ্বাস-সংস্কৃতির মানুষের একসঙ্গে বসবাসের গর্বিত ইতিহাস বয়ে চলা ভারতে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়ন নেমে আসে। কেবল মুসলিমরাই নয়, খোদ সনাতন ধর্মের নিম্নবর্ণের দলিতরাও শিকার হন গণপিটুনির নামে সাম্প্রদায়িক হত্যাকাণ্ডের।
দিল্লির ঘটনায় দেশটির সরকার ও পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হওয়ায় তাদের সমালোচনা করেন দেশটির সুশীল সমাজও। ভারতের নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেন, ‘দেশের রাজধানী ও কেন্দ্রশাসিত দিল্লিতে যা হয়েছে তা নিয়ে আমি খুবই উদ্বিগ্ন। যদি সংখ্যালঘুরা নির্যাতিত হয় এবং পুলিশ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়, সেটা গুরুতর উদ্বেগের বিষয়।’