আরিফ চৌধুরী
চলচ্চিত্র একটি শক্তিশালী বিনোদন মাধ্যম। এই মাধ্যমের ব্যাপ্তি বিশাল জনগোষ্ঠীকে ঘিরে, সমাজকে ঘিরে। বিনোদনের সবচাইতে শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে চলচ্চিত্রের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা আছে সমাজে। বাংলা সাহিত্য তথা অবিভক্ত ভারতবাসীর মধ্যে প্রথম নোবেল প্রাপ্তি (১৯১৩) রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে। আর বাঙালি সংস্কৃতি চেতনার প্রথম চলচ্চিত্র নির্মান করেন উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের জনক হীরালাল সেন। ইউরোপের চলচ্চিত্রের বিকাশের পথ ধরে ১৮৯৮ সালে নিজস্ব রয়েল বায়োস্কোপ কোম্পানীর মাধ্যমে ভারত তথা উপমহাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়। ১৯০১ সালে ৯ ফেব্রুয়ারি তার চলচ্চিত্রায়নে আলী বাবা নাটকে মর্জিনা ও আবদুল্লাহ’র নৃত্য দৃশ্য চলচ্চিত্রে ধারণ করে ভারত তথা উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের সূচনা করেন।সেই সুত্র ধওেরচলচ্চিত্রের শিল্পরুপ যখন বিকশিত হচ্ছে তখন রবীন্দ্রনাথ লেখালেখিতে বিচিত্র চিন্তার উদ্ধেক করেন। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথকে বাঙালিদের মধ্যে প্রথম চলচ্চিত্রে ধারণ করেন চলচ্চিত্রকার হীরালার সেন। ১৯০৫ সালের ১৬ ই অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের দিন কলকাতায় হরতাল ও মিছিল হয়্ সে মিছিলে কবি রবীন্দ্রনাথকে সামনে রেখে বহু গন্যমান্য ব্যক্তি ও আপামর জনগন শোভা যাত্রা বের করে গঙ্গা থীওে সমবেত হয়। সে মিছিলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচিত স্বদেশী সংঙ্গীত জনতার সমবেত কন্ঠে ধ্বনিত হয়। এই বঙ্গভঙ্গ বিক্ষোভের প্রামান্য চিত্র ধারণ করেন চলচ্চিত্রকার হীরালাল সেন।১৯০৫ সালের ২১ ও ২২ অক্টোবর ক্লাসিক থিয়েটারে নাটকের সঙ্গে ঞরিালাল সেনের রয়েল বায়োস্কোপ কোম্পানী বঙ্গভঙ্গের প্রামান্য চিত্র প্রদর্শন করে। কিন্তু ১৯৩০ সালে বরীন্দ্রনাথ ভ্রমণকালে মস্কোর চলচ্চিত্র কর্মীদেও সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের এক আলোচনা বৈঠক ডাকা হয়। যেখানে রবীন্দ্রনাথ সের্গেই আইনেষ্টাইনের ‘বেটেলশিপ পটেমকিন’ ছাড়াও আরো বেশ কটি ছবি উপভোগ করেন বেশ আগ্রহ ভরে। রবীন্দ্রনাথ তার তার রাশিয়া ভ্রমণ নিয়ে লেখালেখিতে চলচ্চিত্র নিয়ে ভাবনা চিন্তার আলো ফেলেছিলেন একই সময়ে ১৯৩০ সালে রবীন্দ্রনাথ জার্মানির ইউফা ষ্টুডিওতে তার গান ও আবৃওির সবাক চিত্রায়নের ব্যাবস্থা করা হয় এবং তাদের অনুরোধে চলচ্চিত্রায়নের জন্য রবীন্দ্রনাথ লেখেন ‘দ্যা চাইল্ড কবিতাটি। যা পরবর্তীতে বাংলায় রুপান্তর করা হয় শিশুতীর্থ নামে। জার্মানির মিউনিখের ষ্টুডিওতে রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতার সবাক রেকডিং হলেও সে সময় চলচ্চিত্রে চলছিলো সবাক যুগ। রবীন্দ্রনাথের তিনটি কাহিনির চলচ্চিত্রায়ন হয়েছিলো শিশির ভাদুরী পরিচালিত ‘বিচারক (১৯২৯) ও ১৯৩০ সালে ম্যাডাম থিয়েটারের ব্যানাওে মধুবোসের পরিচালনায় নির্মিত হয় ‘দালিয়া’ এবং ১৯৩২ সালে নরেশ মিত্রের পরিচালনায় “নৌকাডুবি’ । অন্যদিকে সবাক যুগে রবীন্দ্রনাথের কাহিনীর প্রথম চলচ্চিত্রায়ন ঘটে তাজমহল চলচ্চিত্রের ব্যানারে রবীন্দ্র সাহিত্যের প্রথম চলচ্চিত্রায়ন ঘটে “মানভজ্ঞন’ নিয়ে। নরেশ মিত্রের পডিরচালনায় দাম্পত্য জীবনের নানান জটিলতা নিয়ে আবর্তিত এ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন ইন্দুবালা বন্দ্যোপাধ্যায়, নরেশ মিত্র, তিনকড়ি, মোনা, দূর্গাদাশ, লীলা সহ আরো অনেকে। মানভজ্ঞন গল্পটি বরীন্দ্রনাথ রচনা করেন ১৮৯৫ সালে। এই গল্পের সারংশ হচ্ছে- নায়িকা গিরিবালা স্বামী গোপীনথের প্রেম থেকে বঞ্চিত ছিলেন। গোপীনাথ স্ত্রীকে চরমভাবে উপেক্ষা করেন। স্ত্রীকে ফেলে এক অভিনেত্রীর মোহে আবিষ্ট হয় গোপী। স্বামীর আচরণে ক্ষুদ্ধ হয়ে স্বামীকে নানা কৌশলে সংসার জীবনে ফিরিয়ে আনতে ব্যার্থ হলে নিজেই অভিনেত্রীর জীবন বেছে নেয়। অন্যদিকে, উল্টো স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনতে ব্যার্থ হয়ে গোপী তাকে হত্যার পরিকল্পনা করে। খুনের অঘটন ঘটে যাওয়ার আগে গোপী পুলিশের কাছে ধরা পড়ে। রবীন্দ্রনাথ তার প্রথম কাহিনী চিত্রন ‘মানভজ্ঞন’ দেখার জন্য কলকাতার ক্লাউন সিনেমা হলে গিয়েছিলেন। সেই চলচ্চিত্রের প্রিমিয়ার শো’র মাধ্যমেই উপমহাদেশে চলচ্চিত্রের প্রিমিয়ার শো’ চালু হয়েছিলো। ১৯৪৮ সালে মুক্তি পায় ‘দূষ্টিদান’ নীতীশ বোসের পরিচালনায় ছবিতে ছবি বিশ্বাস, সন্ধ্যারাণী, অসিতবরণ, উরম কুমার (অরূণ কুমার নামে) অভিনয় করেন। ১৯৩২ সালে নিউ থিয়েটারে’র ব্যানাওে দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুরে’র পরিচালনায় মুক্তি পায় ‘নটির পূজা’ চলঅচ্চিত্রঠি। এটি ছিলো শানিত নিকেতনের ছাত্র-ছাত্রীদেও নিবেদিত নটির পূজা গীতিনাট্যও চিত্ররুপ। ১৯৩২ সালে প্রেমাস্কুর আতর্থির পরিচালনায় রাঁইচাঁদ রড়ালের সঙ্গীতে মুক্তি পায় ‘চিরকুমার নভা। ১৯৩৮ সালে মুক্তি পায় নরেশ মিত্র ও দেবদও চলচ্চিত্রের ব্যানাওে মুক্তি পায় ‘গোরা’। যার রাগ সংঙ্গীত পরিচালনায় ছিলেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম।১৯৪০ সালে নির্মিত হয় চোখের বালিও ১৯৪৮ সালে নির্মিত হয় ‘শোধবোধ’। সৌমেন মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় নিউ থিয়েটারে’র প্রযোজনায় ছবিতে অভিনয় করেছিলেন ছবি বিশ্বাস, সুপ্রভা, ভানু ও মলিনা সহ অনেকে। ১৯৪৪ সালে পশুপতি মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় মুক্তি পায় ‘শেষ রক্ষা’। যাতে শূল অভিনয় নকরেছিলেন সত্যজিৎরায়ের স্ত্রী বিজয়া রায়। ১৯৪৭ সালে পূর্ননির্মিত হয় ‘নৌকাডুবি’ ছবিটি। ১৯৫৩ সালে নীতিশ বোসের পরিচালনায় মুক্তি পায় ‘যোগাযোগ’ এবং ১৯৬০ সালে ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন ছবিতে প্রধান ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন চিত্রনায়ক উরম কুমার। ১৯৬০ সালে চলচ্চিত্রকার তপন সিংহের পরিচালনায মুক্তি পায় ‘ক্ষুধিত পাষান’।
ভারতবর্ষেও বঙ্গভঙ্গের আন্দোলনের প্রতিক্রিয়ায় দেশে রাজনীতির উওপ্ত আবহাওয়ার পটভূমিতে রচিত রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে-বাইরে’(১৯১৬) উপন্যাসের চলচ্চিত্রায়নের সফলতার পরিচয় দিয়েছিলেন প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়। ছবিতে বাঙময় সংলাপের আধিক্য আস্তে আস্তে বিষয় নির্ভর ছবির কাহিনীকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াকে ক্রমশ স্পর্শ করেছে ছবির গতিময়তা। ছবিতে নিখিলেশের বাড়ি, শোবার ঘর, বৈঠকখানা, নাটমন্দিও, বিমলা, সন্দ্বীপ, নিখিলেশ, ও মেজোরাণীর পোশাক পরিচ্ছেদ, সর্বোপরী সবকিছ’ যেনো সময়টাকে অত্যন্ত সত্যনিষ্ঠ ও বাস্তব পরিকল্পনায় নিজস্ব শৈলিতে তুলে ধরেছেন। ছবিতে রবীন্দ্রনাথের দুটো গান ও জ্যোতি ঠাকুরের একটি গান সংযোজন করা হয়েছে। নিখিলেশ,বিমলা,ও সন্দ্বীপের ত্রিভূজ প্রেমের সম্পর্কের টানাপোড়েনের সমকাীন বাস্তবতা এ ছবিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
রবীন্দ্রনাথের কাহিনী নির্ভর চলচ্চিত্রের সফল নির্মাতা সত্যজিৎ রায় রবীন্দ্র গল্প ‘পোষ্টমাষ্টার,মনিহার ও সমাপ্তি অবলম্বনে নির্মান করেন তিনকন্যা (১৯৬১)। প্রথম কন্যা পোষ্টমাষ্টার রবীন্দ্র সাহিত্যোর বিখ্যাকত ছোট গল্প, সত্যজিৎ গল্পের চিত্ররুপ দেয়ার ক্ষেত্রে অনেক জায়গায় পরিবর্তন এনছেন যা সাহিত্য থেকে চলচ্চিত্রে রুপ দেয়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় হয়ে উঠে।একইভাবে দ্বিতীয় কন্যা মনিহার ও র্তৃতীয় কন্যা সমাপ্তি রভীন্দ্রনাথের এ গল্পটির চিত্রায়ণে সত্যজিৎ যে অফ’র্ব দৃর্শ্যমালার জন্ম দিয়েছেন তা তা আজও পুরোন হয়নি। তিনকন্যার তিন কন্যাই সমাজের শ্যেণিগত তিনটি স্তর থেকে নেয়া । পোষ্টমাষ্টারের রতন সর্বহারা শ্রেণির মেয়ে। মনিহারে’র মণি-মালিকা উচ্চবিও শ্রেণির নারী,ন সমাপ্তির কিশোরী মৃন্ময়ী নিন্ম মধ্যবিও শ্রেণির মেয়ে। একজন শিল্পী হিসাবে রবীন্দ্র সাহিত্য চলচ্চিত্রায়নে সত্যজিৎ সার্থক ও সৃজনশীলতার স্বাধীনতা নিয়েছেন পুরোপুরি। অন্যদিকে চলচ্চিত্রকার ঋতুপর্ণ ঘোষের চলচ্চিত্রে বরীন্দ্রনাথের ব্যাপক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
এরপর ১৯৬৪ সালে সত্যজিৎতের হাতে নির্মিত হয় অসামান্য চলচ্চিত্র‘ চারুলতা। চলচ্চিত্রের শৈল্পিক ভাষা , সাহিত্য ও চলচ্চিত্রের অর্ন্তনিহিত সর্ম্পকের ব্যাপারে সত্যজিৎতের গভীর শিল্পবোধ মিলেমিশে একাকার হয়েছে ছবির কহিনিতে।সত্যজিৎ রায় ডিনজেই বলেছেন এটি তার সবচেয়ে নপ্রিয় ও নিঁখুত চলচ্চিত্র। রবীন্দ্র সাহিত্যোর শৈল্পিক গুনাবলি ঠিক রেখে নিজস্ব কল্পনা শক্তিতে নতুন শিল্পবোধ দিয়ে সত্যজিৎ রায় রবীন্দ্র সাহিত্যোকে নির্মাণ করেছেন আপন চিন্তা ও চেতনায়।
অন্যদিকে প্রয়াত চলচ্চিত্রকার ঋুুপর্ণ ঘোষ তার জীবদ্দশায় ১৬টি ছবির মধ্যে তিনটি ছবি তিনি নির্মাণ করেন রবীন্দ্রনাথের গল্প অবলম্বনে। যেমন- চোখের বালি,( ২০০৩), নৌকাডুবি (২০১০) ও চিত্রাঙ্গদা। এবং ১৯৯৯ সালে নির্মিত ঋর্তুুপর্ণ ঘোষর ‘অসুখ’ ছবিতে রবীন্দ্রনাথ নিজেই একটি অদৃশ্য চরিত্র। আর ভারত সরকারে’র অর্থায়নে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে ঋতুপর্ণ ঘোষ নির্মান করেন একটি বিশেষ তথ্যচিত্র ‘জীবন স্মৃতি।
১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে ভারত সরকার রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে প্রামান্যচিত্র নির্মানের দায়িত্ব দেন সত্যজিৎ রায়ের উপড়। কবির বিশাল কর্মময় জীবন, অজ¯্র গান, কবিতা, নিয়ে এক ঘন্টার তথ্যচিত্রে রবীন্দ্রনাথের জীবনকে তার শিল্পী স্বত্বা ও মানবতাবাদী বোধকে সিনেমার ভাষায় ধারণ করে তথ্যচিত্র রবীন্দ্রনাথ (১৯৬১) তৈরি করার সক্ষমতা সত্যজিৎ রায়ে’র পক্ষে সম্ভব ছিলো। নিজস্ব চিত্রনাট্য ধারাভাস্য ও পরিচালনায় এ তথ্যচিত্রে অভিনয় করেছিলেন রায়া চ্যাটার্জি, শোভন লাল বন্দোপাধ্যায়, প্রমুখ। ১৯৬১ সালের ১ মে তথ্যচিত্রটির প্রদর্শনী হয়েছিলো একাডেমি অব ফাইন আর্টস অফিসে।
সত্যজিৎ রবীন্দ্র সাহিত্য থেকে শুধু চলচ্চিত্র নির্মান করেননি, রবীন্দ্রনাথের গান চলচ্চিত্রে ব্যাবহারে’র অসামান্য দক্ষতা দেখিয়েছেন।্ একজন শিল্পী হিসাবে সত্যজিৎ রবীন্দ্র সাহিত্য ব্যাবহারের ক্ষেত্রে পুরোপুরি স্বাধীনতা নিয়েছেন। তাইতো সত্যজিৎতের চরুলতা চলচ্চিত্রটি ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র হয়ে আছে। চারুলতার চারু হয়ে আছে মহৎ চরিত্রগুলোর একটি।
রবীন্দ্রনাথ নিয়ে চলচ্চিত্র ভাবনা ও চলচ্চিত্র নিমার্নের মধ্যে দিয়ে উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের বিকাশের পথে হয়েছে আধুনিক চলচ্চিত্র নির্মানের ধারা।
লেখক- আরিফ চৌধুরী, চট্টগ্রাম।
তথ্যসুত্র: রবীন্দ্রনাথ ও চলচ্চিত্র,-মফিদুল হক,
বিষয় চলচ্চিত্র: সত্যজিৎ রায়, চলচ্চিত্রপত্র- বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদ বুলেটিন-১৯৮৬,