আজ : শুক্রবার ║ ১৩ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

আজ : শুক্রবার ║ ১৩ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ║২৮শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ║ ১১ই জমাদিউস সানি, ১৪৪৬ হিজরি

দক্ষিণ চট্টগ্রামের শঙ্খনদী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অস্তিত্ব সংকটে

মো. দেলোয়ার হোসেন, চন্দনাইশ:
চট্টগ্রাম চন্দনাইশের দক্ষিণ সীমান্তে এককালের প্রমত্ত্বা শঙ্খনদী নিয়ে শিল্পীদের রচিত গান ‘শঙ্খনদীর তীরের উপর রসিক বন্ধুর ঘর, দেখা হলে বলবে মনের খবর’, ‘শঙ্খ নদীর মাঝি, আই তোয়ার লগে রাজি’, ‘শঙ্খ নদীর সাম্পান ওয়ালা মোরে পাগল বানাইল’। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের এ চরণ গুলি এখনো অনেকের মন কাড়ে। সে প্রমত্ত্বা শঙ্খনদী বর্তমানে জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে মারাত্মক অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে।
বর্ষাকালে পাহাড়ী ঢলে শঙ্খনদীতে পানির স্রোত দুই পাড়ে থৈ থৈ করে। কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে শঙ্খনদীর বিভিন্ন এলাকায় ডুবু ডুবু চরে ভরেথাকে। হারিয়ে যাচ্ছে অস্তিত্ব। যদিও শঙ্খের দুই পাড়ে শীত মৌসুমে প্রচুর সবজি ফলন হয়। কিন্তু নির্বিচারে পাহাড় ও বনজ সম্পদ ধ্বংস, পানির প্রবাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিসহ নানাবিধ অত্যাচারে এখন অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে শঙ্খনদী। বর্ষা মৌসুমে এ নদীর দু’কুল উপড়িয়ে পড়ে পাহাড়ি ঢল। শুষ্ক মৌসুমেও স্বাভাবিক ছিল নদী চলাচল ও শঙ্খের দুই পাড়ের মানুষের জীবন-জীবিকা। এককালের প্রমত্ত্বা এ শঙ্খ বর্ষা ও শুষ্ক মৌসুমে অস্তিত্ব সংকটে রয়েছে। পাহাড়ী ঢলে আসা পলিমাটির স্তর জমতে জমতে অসংখ্য বালির চর শঙ্খের বুকে মাথাচড়া দিয়ে উঠেছে। ফলে এখন আর শুষ্ক কিংবা বর্ষা কোন মৌসুমে আগের মত সম্পান, বুট ও নৌকা চলে না। ফলে এ প্রমত্ত্বা শঙ্খের দু’কুলে বসবাসকারী জনগণের দুঃখের কারণ হয়ে দাড়িয়েছে।

 

বিভিন্ন সূত্র মতে জানা যায়, পার্শ্ববতী দেশ মায়ানমারের সীমান্তবর্তী আরকান রাজ্যের দুর্গম মদক পাহাড় থেকে সৃষ্ট ২৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ এ শঙ্খনদী বাংলাদেশের পার্বত্য জেলা বান্দরবানের থানছি সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করে। পাহাড়-পর্বত পেরিয়ে বান্দরবানের রুমা, রোয়াংছড়ি, বান্দরবান সদর, চন্দনাইশ, সাতকানিয়া পরবর্তীতে আনোয়ারা, বাঁশখালীর মোহনায় চাঁনখালী অতিক্রম করে বঙ্গোপসাগরে মিলিত হয়েছে। তৎকালীন ব্রিটিশ শাসক চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের গ্যাজেটিয়ারে ১৮৬০ সালে এ নদীকে সাঙ্গু নদী হিসেবে চিহ্নিত করে। সে সময় পাহাড়ী মার্মা অধিবাসীরাও এ নদীর পানি স্বচ্ছ থাকার কারণে এ নদীকে রিগ্রাইকিয়াং অর্থাৎ স্বচ্ছ নদী হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও এ অঞ্চলের মানুষ এটাকে শঙ্খ নদী হিসেবে জেনে আসছে। সরজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, শঙ্খনদীর বান্দরবান, চন্দনাইশের ধোপাছড়ি, দোহাজারী, বৈলতলী, বরমা, চরবরমা, সাতকানিয়া সীমান্ত ছাড়াও বাঁশখালী, প্রেমাশিয়া, খানখানাবাদ, পুকুরিয়া, সাধনপুর, সাতকানিয়ার ধর্মপুর, পুরানগড়, বাজালিয়া, কালিয়াইশ, খাগরিয়া, নলুয়া, আমিলাইশ, চরতী, আনোয়ারার হাইলধর, জুইদন্ডী, রায়পুর এলাকায় এ নদীর বুকে শুষ্ক মৌসুমে কয়েক হাজার বালুচর জেগে উঠে। কোথাও কোথাও বালুচরের দৃশ্য দেখে মনে হয় যেন শঙ্খের নিশানাও বিলুপ্ত হয়ে গেছে। নৌকা-সাম্পান চলাচল করতে পারেনা। আবার শঙ্খের দু’কুলে নানা রকম সবজি চাষও করে থাকে কৃষকেরা। ফলে এককালের প্রমত্ত্বা শঙ্খনদী এখন চরম অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে।
এ নদী মায়ানমারের আরকান রাজ্যের বেশ কয়েকটি জেলা, বাংলাদেশের পার্বত্য জেলা বান্দরবান ও চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলার কয়েকটি উপজেলার লাখ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকার উন্নয়নে প্রত্যক্ষভাবে ভূমিকা রেখে আসছে। পরোক্ষভাবে পুরো চট্টগ্রাম অঞ্চলের এ নদী অর্থনৈতিক, সামাজিক, জীবন বৈচিত্র্যসহ প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে আসছে। বর্তমানে সরকারি, বেসরকারি সংস্থার নজর ও তদারকি না থাকায় এ নদীটি এখন অস্তিত্ব সংকটে। অথচ এ নদীর দু’কুল রক্ষায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে সরকার বান্দরবানের থানছি, রোয়াংছড়ি, রুমা, চট্টগ্রামের চন্দনাইশ, সাতকানিয়া, বাঁশখালী, আনোয়ারায় গত ৪০ বছরে কয়েকশত কোটি টাকা ব্যয় করে বেড়িবাঁধ, ব্লক বসিয়েছেন। শঙ্খনদীর অস্তিত্ব সংকট প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগি অধ্যাপক ও হালদা বিশেষজ্ঞ ড. মনজুরুল কিবরিয়া পূর্বকোণকে বলেছেন, প্রথমত: পাহাড়ের গাছ ও মাটি কর্তনের ফলে বর্ষা মৌসুমে প্রচুর পরিমাণ পলি প্রবাহিত হয়। দ্বিতীয়ত: এ নদীর বিভিন্ন শাখাগুলোতে পানির গতি বাঁধাগ্রস্থ করে অপরিকল্পিত সুইচ গেইট, কালভার্ট, বাঁধ এমনকি অনেক ছোট ছোট ছড়া বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তাছাড়া পাহাড়ি এলাকায় বর্তমানে গাছ নিধন করে জুম চাষসহ বিভিন্ন ধরনের চাষাবাদ করা হচ্ছে। বৃষ্টি হলেই বৃষ্টির পানির সাথে পলি শাখা নদী না পেয়ে সরাসরি শঙ্খনদীতে চলে আসছে। ফলে নদীতে পলি জমা শুরু করেছে। বিশেষ করে ১৯৮১ সালের তথা আশির দশকের পর থেকে এ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেছে। নদীর যে প্রবাহ, সে প্রবাহ না থাকায় তাকে আর নদী বলা যায় না। শঙ্খ নদী এখন তার অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলতে বসেছে। জোয়ারের পানিতে নদীর গভীরতা কম থাকায় যেভাবে পানি উপর দিকে যাওয়ার কথা, সেটাও সঠিকভাবে হচ্ছে না। নদী আসতে আসতে সংকোচিত হয়ে আসছে। গভীরতা কমে যাওয়ায় জীব বৈচিত্র্য কমে যাচ্ছে। নদীর প্রবাহ না থাকলে ঐতিহ্যবাহী এ শঙ্খনদী একদিন আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে যাবে। মানুষের কৃত্রিম সৃষ্টি প্রতিবন্ধকতা শঙ্খনদীর অস্তিত্ব সংকটাপন্ন অবস্থায় নিয়ে যাচ্ছে বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেছেন। এ জন্য তিনি সরকারিভাবে প্রয়োজনে শঙ্খ নদীতে ড্রেজিং এর মাধ্যমে সচল রাখার জন্য কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করেছেন। বিভিন্ন রকম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির কারণে পর্যাপ্ত পানি আসতে না পারায় শঙ্খ নদীতে এ পলি জমে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ের মাটি ও বনজ সম্পদ কর্তন বন্ধ করাসহ মনুষ্য সৃষ্টি ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ বন্ধ করা না গেলে এককালের প্রমত্ত্বা এ শঙ্খনদীটিও হারিয়ে যেতে পারে বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেছেন।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

আজকের সর্বশেষ সংবাদ