‘স্কুল-কলেজে ঠিকমতো ক্লাস না নেওয়ায় শিক্ষার্থীরা কোচিং করতে বাধ্য হচ্ছে। শিক্ষকরা যদি ঠিকমতো ক্লাস নেয় তাহলে কোচিংয়ের প্রয়োজন হয় না। আমাদের সময় তো আমরা ক্লাসেই শিক্ষার্থীদের বই শেষ করে দিতাম। এরপরও না বুঝলে বাড়িতে এসে বুঝে যেতো। প্রাইভেট কিংবা কোচিং বলতে কিছু ছিল না।’ কথাগুলো বলছিলেন বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার ডিকেপি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধানশিক্ষক কাঞ্চন আলী সিকদার (৯০)।
২৪ বছর আগে এই শিক্ষক অবসরে গিয়েছেন। কিন্তু পড়ানোর নেশা ছাড়তে পারেননি। এখন বিনা পারিশ্রমিকে বাকেরগঞ্জ গারুরিয়া বিলকিস জাহান টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কলেজে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ইংরেজির ক্লাস নেন তিনি। ওই কলেজের অধ্যক্ষ হচ্ছেন তারই ছেলে জুবায়ের আলম।
কাঞ্চন সিকদার বলেন, ‘৩৮ বছর ইংরেজির শিক্ষকতা করেছি। কর্মজীবনে সাতটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছি। ওই সময়ও আমি প্রতিদিন বিভিন্ন শ্রেণিতে ইংরেজির ক্লাস নিতাম। ক্লাস নেওয়ার ফাঁকে বোঝার চেষ্টা করতাম যাদের জন্য কষ্ট করছি সেই শিক্ষার্থীরা আমার ভাষা ভালোভাবে হজম করতে পারছে কিনা। না বুঝলে আবার বোঝাতাম। এরপরও অনেক শিক্ষার্থী বাড়িতে গিয়ে হাজির হতো। এজন্য তাদের কাছ থেকে কোনও টাকা নিতাম না। ’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের সময় কোচিং কিংবা প্রাইভেট বলতে কিছু ছিল না। আর শিক্ষার্থীরা প্রাইভেট পড়তে চাইলে ধমক দিতাম। তাদেরকে ক্লাসের শিক্ষকের বাড়িতে গিয়ে সাহায্য নেওয়ার পরামর্শ দিতাম। শিক্ষকদেরও বলে দেওয়া হতো সহায়তা করতে। এ কারণে ওই সময় শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের মারাত্মক ভক্তি করতো। সে ভক্তি তো এখন আমি দেখছি না। এখনও আমার শিক্ষার্থীরা আমাকে দেখলে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে। পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে। বর্তমান শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ সম্পর্ক নেই বললেই চলে। এজন্য উভয়ই দায়ী।’
কাঞ্চন সিকদার বর্তমান শিক্ষকদের উদ্দেশে বলেন, ‘সরকার আপনাদের ভালো বেতন থেকে শুরু করে লেখাপড়া করানোর ভালো পরিবেশ দিচ্ছে। কোথাও কোনও কার্পণ্য নেই। আপনারাই (শিক্ষক) পারেন এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে। প্রাইভেটে যেভাবে পড়া বুঝাচ্ছেন সেটা ক্লাসেই শেষ করেন। তাহলে তো শিক্ষার্থীদের আর প্রাইভেট কিংবা কোচিং বাণিজ্যের দিকে ছুটতে হয় না। আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষ নিম্ন ও মধ্যবিত্ত।’
বিলকিস জাহান টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কলেজের অধ্যক্ষ জুবায়ের আলম বলেন, ‘আমার বাবা নিজের ইচ্ছায় ক্লাস নিচ্ছেন। তিনি যখন ক্লাস নেন তখন দুই পিরিয়ড চলে যায়। তারপরও শিক্ষার্থীরা মনোযোগ সহকারে পড়া বোঝার চেষ্টা করে। মাঝে মধ্যে ক্লাস না নিলে শিক্ষার্থীরা আমার কাছে চলে আসে তাদের শিক্ষকের খবর নিতে।’
এ কলেজের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি বাকেরগঞ্জের ইউএনও মাধবী রানী রায় বলেন, এই বয়সে ক্লাস নেওয়া এবং শিক্ষার্থীদের বোঝাতে সক্ষম হওয়া এটা আসলে একটি দৃষ্টান্ত।