
দেশচিন্তা ডেস্ক: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার বলেছেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব নিয়ে ষড়যন্ত্র এখনো শেষ হয়নি। বর্তমানে জাতীয়ভাবে আমরা সংকটকাল অতিক্রম করছি। এ ষড়যন্ত্র ও সংকটকাল মোকাবেলায় দেশের সত্যিকার বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা প্রয়োজন। যুগে যুগে একেকটা দেশের বা রাষ্ট্রের সংকটকালে বুদ্ধিজীবীরাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। কিন্তু দু:খজনক হলেও সত্য আমাদের অনেক বুদ্ধিজীবী বিক্রি হয়ে যেতে দেখা গেছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উদ্যোগে যথাযোগ্য মর্যাদা ও ভাবগম্ভীর পরিবেশে ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন উপলক্ষে রবিবার (১৪ ডিসেম্বর ২০২৫) বেলা ১১টায় চবি উপাচার্য দপ্তরের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার।
এর আগে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন উপলক্ষে আজ রবিবার সকাল ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার, মাননীয় উপ-উপাচার্য (একাডেমিক) প্রফেসর ড. মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান, মাননীয় উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) প্রফেসর ড. মোঃ কামাল উদ্দিন, চবি রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) প্রফেসর ড. মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম, বিভিন্ন অনুষদের ডিনবৃন্দ এবং প্রশাসনের সংশ্লিষ্টদের সাথে নিয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পার্ঘ অর্পণের মাধ্যমে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। পুস্পার্ঘ অর্পণ শেষে মাননীয় উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যদ্বয়ের নেতৃত্বে চবি শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ চত্বর থেকে শোক র্যালি চবি কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার, কলা ও মাবনবিদ্যা অনুষদ (পুরাতন) প্রদক্ষিণ করে প্রশাসনিক ভবনের সামনে এসে শেষ হয়।
এরপর চবি উপাচার্য দপ্তরের সম্মেলন কক্ষে বেলা ১১টায় ‘মুক্তচিন্তা, মুক্তিযুদ্ধ এবং একাত্তরের বুদ্ধিজীবী হত্যা’ শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার। বিশেষ অতিথি ছিলেন চবি মাননীয় উপ-উপাচার্য (একাডেমিক) প্রফেসর ড. মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান এবং অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন মাননীয় উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) ও অনুষ্ঠানের আহ্বায়ক প্রফেসর ড. মোঃ কামাল উদ্দিন।
আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে চবি উপাচার্য প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার বলেন, হত্যার শিকার বেশিরভাগ বুদ্ধিজীবী ছিল শিক্ষক। শিক্ষকরা বুদ্ধিজীবীদের বড় একটা অংশ। কারণ শিক্ষকরা সব সময় জ্ঞানের চর্চার মধ্যে থাকেন। এজন্য শিক্ষকদের দায়িত্ব বেশি। শিক্ষকদের প্রতি অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনের মাধ্যমে বুদ্ধিজীবীতা চর্চা ধরে রাখতে হবে। তাহলেই সমাজে সত্য উদঘাটন হবে এবং প্রতিষ্ঠিত হবে। শুধু শিক্ষক নয়, প্রত্যেক নাগরিককে নিজ নিজ জায়গা থেকে বুদ্ধিজীবী চর্চার সুযোগ রয়েছে। প্রত্যেক নাগরিক নিজেদের দায়িত্বের প্রতি সচেতন এবং নিজ দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করলে এ দেশ বিপথে যাবে না। বিগত সময়ে অনেক বুদ্ধিজীবী নিজের সুবিধা মতো লিখেছেন, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে কলম ধরেননি। উপাচার্য বলেন, আমাদের দেশের প্রতি শিক্ষাগত এবং সাংস্কৃতিক আগ্রাসন কমেনি। তাছাড়া পাশ্ববর্তী দেশের আধিপত্যবাদী মনোভাব আমাদের ওপর এখনো গ্রাস করে আছে। আজকের এ দিনে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি। পাশাপাশি শহীদদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।
চবি উপ-উপাচার্য (একাডেমিক) প্রফেসর ড. মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন। তিনি ৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ৭১ এর স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং ২৪ এর জুলাই আন্দোলনে সকল শহীদের মাগফেরাত কামনা করেন। তিনি বলেন, সত্যিকার ইতিহাস জানতে হলে সত্যিকার ইতিহাস জানার পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। ১৯৭১ সালে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ড আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশ কিনা খতিয়ে দেখার আহ্বান জানান তিনি। তিনি বলেন, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে আমরা অনেক কিছুই জানি না। এজন্য এ ব্যাপারে স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করার জন্যও বর্তমান সরকারের কাছে আহ্বান জানান তিনি। তিনি বলেন, ইতিহাস বিকৃত হয় লেখালেখির মাধ্যমে। আমাদের অনেক পত্রপত্রিকা, লেখকরাই অনেক ইতিহাস বিকৃতের জন্য দায়ী। এজন্য সকলকে সঠিক ইতিহাস জানার আহ্বান জানান তিনি।
আলোচনা সভার সভাপতি ও অনুষ্ঠানের আহ্বায়ক চবি মাননীয় উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) প্রফেসর ড. মোঃ কামাল উদ্দিন বলেন, পৃথিবীর বড় বুদ্ধিজীবীদের একজন ছিলেন সক্রেটিস। সত্য ও স্বাধীনভাবে কথা বলার জন্য তাকে হত্যা করা হয়। একইভাবে গ্যালিলিওসহ সময়ে সময়ে বহু বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা শুধুমাত্র সত্য কথা বলার জন্য। যারা সত্য কথা বলে, ন্যায়ের কথা বলে, তারাই প্রকৃত বুদ্ধিজীবী। কিন্তু আমাদের সমাজে অনেক বুদ্ধিজীবী আছেন বা ছিলেন তারা ততটুকুই বুদ্ধিজীবী যতটুকু বুদ্ধিজীবীতা করলে তাদের সুযোগ-সুবিধার অভাব হবে না। আমাদের অনেক বুদ্ধিজীবী শুধু নিজেদের সুবিধা নিয়ে কথা বলেন। এজন্য আমাদের প্রত্যেকের জায়গা থেকে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে। সঠিকভাবে বুদ্ধিজীবী চর্চার মাধ্যমে সমাজ তথা রাষ্ট্রের সেবা করতে হবে। তিনি শহীদ বুদ্ধিজীবীসহ সকল শহীদদের মাগফেরাত কামনা করেন। তিনি সুন্দর বাংলাদেশ বিনির্মাণে দলমত নির্বিশেষে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সত্য-ন্যায়ের কথা বলার আহ্বান জানান।
প্রবন্ধ উপস্থাপকের বক্তব্যে চবি ইতিহাস বিভাগের প্রফেসর ও চবি জাদুঘরের পরিচালক ড. মোহাম্মদ জাহিদুর রহমান বলেন, মুক্তিযুদ্ধে গোটা বাংলায় চালানো ব্যাপক হত্যাকাণ্ডের মধ্যে অন্যতম একটি ঘটনা হচ্ছে একাত্তরের বুদ্ধিজীবী হত্যা, যা সন্দেহাতীতভাবে টারগেটেড কিলিং। এ নিয়ে এ যাবত লেখা গবেষণাপত্রে দুটি বয়ান প্রাধান্য পেয়েছে। একটি বয়ান ঐ ঘটনাকে ১৯৪৮ এর জেনেভা কনভেনশান মোতাবেক জেনোসাইড হিসাবে প্রতিপন্ন করে। আরেকটি ন্যারেটিভের দাবি বাঙ্গালি জাতিকে পুরোপুরি মেধাশুন্য করে দেয়া; যাতে স্বাধীনতা পেলেও এই জাতি আর মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। প্রথম বয়ানটির বৈধতা আইনসিদ্ধ আর দ্বিতীয় বয়ানে আমার কোন সায় নেই। তাই, এক্ষেত্রে আমার গবেষণাযোগ্য প্রশ্ন হচ্ছে কেন বা কি অপরাধে, একেবারে বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হলো? তাৎক্ষণিকভাবে এই ঐতিহাসিক হত্যাকাণ্ডের পেছনে একটি রাজনৈতিক কারণকে বারবার সামনে আনা হলেও এর শেকড় মাটির বহু গভীরে গ্রথিত। আমি আমার গোটা প্রবন্ধে ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতির আলপথ বেয়ে সেই কার্যকারণ অনুসন্ধানে মগ্ন থাকার চেষ্টা করবো।
চবি প্রক্টর প্রফেসর ড. হোসেন শহীদ সরওয়ার্দীর সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন, চবি রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) প্রফেসর ড. মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম। এসময় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, চবি বিজ্ঞান অনুসদের ডিন প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আল-আমীন, চবি সিন্ডিকেট সদস্য ও চবি অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর ড. আবুল কালাম আজাদ, চবি অতীশ দীপঙ্কর হলের প্রভোস্ট এ.জি.এম নিয়াজ উদ্দিন, চবি ছাত্র-ছাত্রী পরামর্শ ও নির্দেশনা কেন্দ্রের পরিচালক ড. মো. আনোয়ার হোসেন, চবি অফিসার সমিতির সভাপতি রশীদুল হায়দার জাবেদ, চাকসুর ভিপি ইব্রাহীম হোসেন রনি, চাকসুর জিএস সাঈদ বিন হাবিব, চাকসুর এজিএস আইয়ুবুর রহমান তৌফিক ও চবি কর্মচারী সমিতির সহ-সভাপতি আমির হোসেন। সভায় শহীদ বুদ্ধিজীবীসহ সকল শহীদদের রুহের মাগফেরাত কামনা করে দোয়া ও মোনাজাত পরিচালনা করেন চবি কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের খতিব হাফেজ আবু দাউদ মুহাম্মদ মামুন। অনুষ্ঠানে শহীদদের সম্মানে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এছাড়া অনুষ্ঠানের শুরুতে পবিত্র গ্রন্থসমূহ হতে পাঠ করা হয়। পবিত্র কোরআন থেকে পাঠ করেন চবি কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের খতিব হাফেজ আবু দাউদ মুহাম্মদ মামুন, পবিত্র গীতা থেকে পাঠ করেন চবি সংস্কৃত বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. রাজপতি দাশ, পবিত্র ত্রিপিটক থেকে পাঠ করেন চবি পালি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শাসনানন্দ বড়ুয়া রুপন ও পবিত্র বাইবেল থেতে পাঠ করেন চবি ফার্মেসি বিভাগের শিক্ষার্থী প্রিয়াঙ্কা পিংকি দারিং।
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের কর্মসূচির অংশ হিসেবে এদিন সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবনসমূহে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয় এবং কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়। ফজরের নামাজের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল মসজিদে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের রুহের মাগফেরাত কামনা করে বিশেষ মোনাজাত ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের স্ব স্ব উপাসনালয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মার শান্তি কামনা করে প্রার্থনা করা হয়। এছাড়া শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে কালো ব্যাজ ধারণ করা হয়।
















