ডলার সংকটের অজুহাতে ফল আমদানি শূন্যের কোটায়। ফলে দীর্ঘসময় ধরে বাজারেও চলছে ফলের তীব্র সংকট। এমন দাবি আমদানিকারকদের। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে চট্টগ্রাম বন্দরে পড়ে আছে ফলের এক হাজার কনটেইনার। যাকে বলা হচ্ছে মজুতের কৌশল। বাজারে ফলের সংকটও তারই অংশ।
এমন অভিযোগ কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সভাপতি জেসমিন সুলতানা পারুর। তিনি বলেন, বাজারে ভোগ্যপণ্যের বাজারের সিন্ডিকেটের মতো ফল ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটও বেশ প্রভাবশালী। চট্টগ্রামের পাইকারি ফলের বাজার ফলমন্ডির নিয়ন্ত্রণও তাদের হাতে। যেখান থেকে পুরো চট্টগ্রাম শহর ও জেলার বিভিন্ন উপজেলার সবকটি হাটবাজারে ফল সরবরাহ হয়। আর এই প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে এই ফল সিন্ডিকেট কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে হাতিয়ে নিচ্ছে ভোক্তা সাধারণের পকেটের টাকা।
তিনি বলেন, ডলার সংকটের অজুহাতে ফল আমদানি বন্ধ দেখিয়ে বাজারে ক্রয়মূল্যের দ্বিগুণ, এমনকি তিনগুণ বেশি দামে ফল বিক্রি করে শতকোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এই ফল ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। রোজার আগেও তারা ফল আমদানি শূন্যের কোটায় বলে রমজানে দ্বিগুণ-তিনগুণ বেশি দামে ফল বিক্রি করে ভোক্তাদের রক্ত চুষে খাচ্ছে। অথচ চট্টগ্রাম বন্দরে পড়ে আছে তাদের আমদানি করা হাজারো কনটেইনার ভর্তি ফল। যা একরকম মজুত বলা যায়। আর ফলের এসব কনটেইনার নিয়ে বিপাকে রয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষও।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, রমজানের আগে ১ হাজার কনটেইনার ভর্তি ৪০ হাজার টন আপেল-কমলা-মাল্টা এবং আঙুর চট্টগ্রাম বন্দরে মজুত করে রেখেছেন আমদানিকারকরা। রেফার কনটেইনারে আনা এসব ফল দ্রুত ডেলিভারি নিতে আমদানিকারকদের দুই দফা চিঠি দিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। ফলগুলো ডেলিভারি নিলে বন্দরের শেড খালি হতো। বাজারে ফলের সরবরাহ বাড়ত। কমত দামও।
সূত্র জানায়, বর্তমানে পাইকারি পর্যায়ে ২০ কেজির এক ক্যারেট আপেল ৪ হাজার ৭০০ টাকা, কমলা ৪ হাজার টাকা, ১৫ কেজির এক ক্যারেট মাল্টা ৩ হাজার ২০০ টাকা এবং ২২ কেজির আঙুর সাড়ে ৬ হাজার টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। তবে খুচরা পর্যায়ে এসব ফলের দাম দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ বেশি।
সরেজমিন দেখা গেছে, চট্টগ্রাম মহানগরীতে আমদানি করা মাল্টা খুচরায় বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৩০০ টাকায়, আপেল ২৮০ টাকায়। ভালোমানের আপেল ৩০০ টাকায়ও বিক্রি হচ্ছে। চীন থেকে আমদানি করা পাতাসহ কমলা বিক্রি হচ্ছে ৪০০ টাকায়। আঙুর প্রতি কেজি বিক্রয় হচ্ছে ৬০০ টাকায়।
যদিও পাইকারি আড়ত ফলমন্ডিতে চীনা আপেল প্রতি কেজি পাইকারি রেট ১৭০ টাকা থেকে ১৮০ টাকা। আবার দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আমদানি করা আপেল পাইকারিতে ১৯০ থেকে ২০০ টাকা, চীন থেকে আমদানি করা কমলা ১৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি। প্রতিটি ফলের আইটেম পাইকারি ও খুচরায় দামের ফারাক হচ্ছে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত।
পাইকারির চেয়ে খুচরায় ফলের দামের বিস্তর ফারাক সম্পর্কে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মহানগরীর বহদ্দারহাটের খুচরা ফল ব্যবসায়ী কামাল উদ্দিন বলেন, ‘পাইকারদের কাছে ফল কিছুদিন সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু আমাদের মতো খুচরা ব্যবসায়ীদের তো সেই সুযোগ নেই।’
তিনি জানান, পাইকারদের কাছ থেকে কেনা ফলমূল কয়েকদিনের মধ্যে বিক্রি করে ফেলতে হয়। তা না হলে পচে নষ্ট হয়। দুই কেজি নষ্ট হলে ব্যবসায় বিরাট ক্ষতি। তাই আমরা কিছুটা বাড়তি দামে ফল বিক্রি করি। যাতে নষ্ট হওয়া ফলের ক্ষতি কিছুটা হলেও পুষিয়ে নিতে পারি। আর এখন তো বাজারে ফলের তীব্র সংকট চলছে বলে জানান কামাল উদ্দিন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফলমন্ডির আড়তদার আবুল কালাম বলেন, বছরের এই সময় বিশেষ করে রমজানের আগ মুহূর্তে ফলের মজুত বেশি থাকার কথা। কিন্তু বর্তমানে সেই পরিমাণ ফল মজুত নেই এখানে। ফল আমদানি হলেও সেগুলো রয়ে গেছে চট্টগ্রাম বন্দরে। ফলে বাজারে ফলের সংকট চলছে। দামও বেড়েছে।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের উপ-কমিশনার কাজী ইরাজ ইশতিয়াক বলেন, আমদানি তথ্য অনুযায়ী বাজারে সংকট হওয়ার কথা নয়। তবে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করতে ইচ্ছে করে আমদানিকৃত ফল কনটেইনারে ফেলে রাখা হয়েছে। যা এক প্রকার মজুত বলা যায়। এটা একটা কৌশল। তবে সেটি যাতে কেউ করতে না পারে সেদিকে নজর রাখা হচ্ছে।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের গত আট মাসে ১ লাখ ৪ হাজার টন আপেল, ৫৮ হাজার ২৫৮ টন কমলা, ৫৫ হাজার ৮৩৫ টন মাল্টা এবং ২৯ হাজার ৪৭০ টন আঙুর আমদানি হয়েছে।
দেশীয় কমলার স্বাদ ভালো হওয়ায় বিদেশি কমলা কিছুটা আমদানি কম হলেও বাকি অন্যান্য ফল আমদানি হয়েছে গত বছরের তুলনায় অনেক বেশি। ডলার সংকট সত্বেও আট মাসে ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকার আড়াই লাখ টন ফল আমদানি হয়েছে। যা চাহিদার বিপরীতে অতিরিক্ত। এরপরও বাজারে কোনোভাবেই কমছে না ফলের দাম। রোজা শুরু হওয়ার সাথে সাথে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির সুযোগে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ফলের দাম।
এদিকে বন্দরে ফল ফেলে রেখে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির অভিযোগ মানতে নারাজ আমদানিকারকরা। এবার দাম বাড়ানোর অজুহাত হিসেবে দেখাচ্ছেন লোহিত সাগরে হুতি বিদ্রোহীদের হামলায় জাহাজ চলাচলে বিঘ্ন ঘটাকে। অথচ বাংলাদেশে দক্ষিণ আফ্রিকার পাশাপাশি চীন ও মিশর থেকে আপেল, কমলা ও মাল্টা সবচেয়ে বেশি আমদানি হয়।
বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুট ইম্পোটার্স অ্যাসোয়িশেনের সাংগঠনিক সম্পাদক তৌহিদুল আলম বলেন, কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে কোনো আমদানিকারক ফল বিক্রি করছে না। চাহিদা অনুযায়ীই বাজারে ফল সরবরাহ করা হচ্ছে। চাহিদা না থাকায় বন্দর থেকে ফলের কনটেইনার খালাসে নিচ্ছে না।
তিনি বলেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরুর পর থেকে সব ভোগ্যপণ্যের মতো ফল আমদানিতেও প্রভাব পড়ে। ডলার সংকটের কারণে ব্যাংকে এলসি (ঋণপত্র) খুলতে না পারায় এই সংকট তৈরি হয়। এই সংকট দিন দিন বাড়ছে। ফলে ক্রমেই কমে যাচ্ছে ফল আমদানি।
তিনি আরও বলেন, ‘করোনাকালীন সময়েও যেখানে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে প্রতি মাসে গড়ে ১০০ কনটেইনার ফল আমদানি হতো সেখানে এখন প্রতি মাসে গড়ে আমদানি ঠেকেছে ২০ কনটেইনারে। আমি নিজে প্রতি মাসে ৫০ থেকে ৬০ কনটেইনার ফল আমদানি করতাম। এখন আমদানি করছি ৫ থেকে ৬ কনটেইনার ফল।’
ব্যবসায়ীদের মতে, ভারত-মিয়ানমারের পাশাপাশি দক্ষিণ আফ্রিকা, আফগানিস্তান, চীন, ভিয়েতনাম এবং থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হয় নানা প্রজাতির ফলমূল। এর মধ্যে আছে মাল্টা, আপেল, ডালিম, কমলা, আনার, আঙুর, খেজুর এবং স্ট্রবেরি। ফলমন্ডির ফল চট্টগ্রামের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ হয়ে থাকে।
সূত্র মতে, নতুন ও পুরনো ৩০০ ফলের আড়ত ও দোকান রয়েছে ফলমন্ডিতে। যেখানে দিনে অন্তত দেড়শ কোটি টাকা থেকে ২০০ কোটি টাকার ফলমূল বিক্রয় হয়।