আজ : রবিবার ║ ৩রা নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

আজ : রবিবার ║ ৩রা নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ║১৮ই কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ║ ১লা জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরি

চট্টগ্রাম চন্দনাইশ দোহাজারী আখেরী ষ্টেশনের ইতিহাস এখনো ভুলেনি মানুষ

মো. দেলোয়ার হোসেন, চন্দনাইশ:
দক্ষিণ চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী এলাকা দোহাজারীতে অবস্থিত রেলওয়ে আখেরী ষ্টেশনের ইতিহাস এখনো মানুষ ভুলেনি। যে ষ্টেশনের নামে একটি সিনেমাও নির্মাণ করা হয়েছিল। সম্প্রতি বর্তমান সরকার পর্যটন নগরী কক্সবাজার পর্যন্ত রেল লাইন সম্প্রসারণের কাজ শুরু করেছেন।
১৬৬৬ সালে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় দোহাজারীতে ক্যাম্প স্থাপিত হয়েছিল। দোহাজারী লালুটিয়াতে ময়নার বাপের পাহাড়ে ক্যাম্পের অফিস ছিল। দিয়াকুল আশ্রমের পাশে ছিল রান্নাঘর। ১৬৬৬ সালে মোগল শাসন আমলে সুবেদার শাসিত রাজধানী ছিল এ দোহাজারীতে। আধু খান ও লসমন সিংহ হাজারী শঙ্খনদীর দু’পাড়ে তাদের ২ হাজার সৈন্য দেয়। সেখান থেকে দু’হাজার সৈন্য থেকে দোহাজারীর নামকরণ হয়েছিল বলে স্থানীয়ভাবে জানা যায়।
যুদ্ধ পরিসমাপ্তির পর আরকান জয় হয়। শের শাহ এ অঞ্চলের রাজা বা শাসক ছিলেন। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে দোহাজারী বারুদখানা এলাকায় গোলাবারুদ রাখা হয়, সেখানে অস্ত্রের ঘাঁটিও ছিল। দোহাজারী দেওয়ানহাটের চরে মাইন (বোমা) পড়ত। হাশিমপুর বাগিচাহাট এলাকায় ছিল তাদের বাগিচা এবং খাদ্য মজুদ রাখার ভান্ডার। সে কারণে হাটটির নাম বাগিচাহাট এবং ভান্ডার খানা থাকায় ভান্ডারী পাড়া নামকরণ হয়েছিল। সেখানে একটি তাদের খনন করা খানদীঘিও রয়েছে।
দোহাজারী সে মোগল শাসন আমল থেকে পরিচিতি লাভ করে। পরবর্তীতে ১৯৩০ সালে খান পরিবারের গৃহবধূকে স্বসম্মানে আনার জন্য নির্মাণ করা হয়েছিল দোহাজারী পর্যন্ত রেল লাইন। সে ঐতিহ্যবাহী পরিবারের এ স্মৃতিচিহ্ন ধরে রাখার জন্য চলচ্চিত্র কারকেরা ষাটের দশকে তৎকালীন খুবই জনপ্রিয় অভিনেতা-অভিনেত্রী রহমান-শবনমকে নিয়ে নির্মাণ করা হয়েছিল ‘আখেরী ষ্টেশন’ নামে সিনেমাটি। এ সিনেমাটির দৃশ্যপট নেয়া হয়েছিল দোহাজারী রেল ষ্টেশন তথা আখেরী ষ্টেশন থেকে। যা এখনো মানুষ ভুলেনি। এখন সে দোহাজারী রেল ষ্টেশন তথা আখেরী ষ্টেশনের সে ব্যস্ততা নেই। চারিদিকে নির্জনতা, ষ্টেশন চত্বরে কিছু ছিন্নমূল মানুষ ও গরু ছড়তে দেখা যায়। ষ্টেশন কর্মকর্তার কার্যালয়ে তালাবদ্ধ, নেই অন্য কোন কর্মকর্তা-কর্মচারীও। খালি মাঠ যেন গরু-ছাগলের চারণ ভূমি। সম্প্রতি বর্তমান সরকার দোহাজারী রেল লাইনকে পর্যটন নগরী কক্সবাজার পর্যন্ত নির্মাণ কাজ শুরু করায় দৃশ্যপট পরিবর্তন হতে যাচ্ছে।
স্থানীয় লোকজন রেলওয়ের ষ্টেশনের পরে আর কোন লাইন না থাকায় এ ষ্টেশনকে আখেরী ষ্টেশন বলে থাকে এবং সে থেকে ‘আখেরী ষ্টেশন’ নামে একটি সিনেমা নির্মিত হয়। সে নামটি মানুষের কাছে বিশেষভাবে পরিচিত হয়ে উঠে। এক সময়ের ব্যস্ত এ রেল ষ্টেশন নির্জন আর গরু-ছাগলের চারণ ভূমি হলো কি কারণে? এ ব্যাপারে স্থানীয়রা বলেন, এক সময় ছয় জোড়া ট্রেন চলাচল করত। এখন মাত্র এক জোড়া ট্রেন চলাচল করে। তাও ভোরে ষ্টেশন ছাড়ে, গভীর রাতে আসে। ফলে আস্তে আস্তে এ আখেরী ষ্টেশনটি নির্জনতায় পরিনত হয়। তারা আরো বলেন, এ ট্রেনে যাত্রীদের মধ্যে মাদক ব্যবসায়ী, পতিতা, কাঠ পাচারকারী সহ অসামাজিক কার্যক্রমে জড়িতরাই বর্তমানে চলাচল করে থাকে। তাছাড়া রাতের আঁধারে ডাকাতি করে অতি ভোরে ডাকাতেরা এ ট্রেনে করে চট্টগ্রাম শহরে যাতায়াত করে থাকে নিরাপদে। তাদের মতে-সড়ক পথের চেয়ে অকেজো এ রেলপথ ডাকাতের জন্য খুবই নিরাপদ। রেল লাইন সংস্কার কার্যক্রম হলে হয়ত এ দৃশ্যপট পরিবর্তন হয়ে আবার দোহাজরী রেল ষ্টেশন তার পুরানো যৌবন ফিরে পাবে।
ব্রিটিশ শাসন আমলে এ আখেরী ষ্টেশনটি নির্মাণ করতে দেখেছেন এদের মধ্যে একজন আমানত খান (৯০) বললেন, তাঁর বয়স তখন ৯ থেকে ১০ বছর ছিল। ষ্টেশনটি ব্রিটিশ সরকার স্থাপন করেছিলেন। পরে উদ্বোধনের জন্য দিনক্ষণও নির্ধারন করা হল। কিন্তু কোন চালকই কালুরঘাট সেতুর উপর দিয়ে ট্রেন চালিয়ে দোহাজারী আসতে রাজি হচ্ছেন না। পরে নাজিরহাট এলাকার জনৈক বাদশা মিয়ার নামের এক চালক প্রথম ট্রেন চালিয়ে দোহাজারী আসেন। সেদিন এ বিশাল আকৃতির ট্রেনটি দেখার জন্য বহু লোক জড়ো হয়েছিল এ আখেরী ষ্টেশনে। পরে রেললাইনকে ঘিরে কাঠ, লবণ, সবজি ব্যবসার প্রসার দিন দিন ঘটতে থাকে। দক্ষিণ চট্টগ্রামের বৃহৎ ও অতি ব্যস্ততম ষ্টেশন হয়ে উঠে দোহাজারী রেলওয়ে ষ্টেশন। দিন-রাত মানুষের যাতায়াত, বিভিন্ন পণ্য উঠানামা, কুলি ও শ্রমিকদের ব্যস্ততম জীবন। সব মিলিয়ে আখেরী ষ্টেশন ছিল দিন-রাত মানুষের মেলা।
সরকারি অবমেলায় দিন দিন এ ষ্টেশনটি হয়ে পড়েছিল যেন মানুষ শূন্য। এখন গভীর রাতে একটি ট্রেন আসে, ষ্টেশন ছেড়ে যায় ফজরের আযানের সময়। সারাদিন ষ্টেশন থাকে নিরব-নিথর। রেললাইনের শেষ প্রান্তে রেলওয়ের জায়গা দখল করে অনেকে বাড়ীঘর নির্মাণ করে বিনা বাঁধায় ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। এসব বাসিন্দারা মাদক, হিরোইন ব্যবসা সহ চুরি-ডাকাতির সাথেও অনেকে জড়িত রয়েছে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। সে সাথে এ সকল ভাসমান বাসিন্দাদের মলত্যাগ করছে উন্মুক্ত অবস্থায় শঙ্খের পাড়ে। গড়ে উঠেছে বার্মাইয়াদের নাম দিয়ে বার্মা কলোনী। স্থানীয়দের মতে দোহাজারী রেল ষ্টেশনের অফিস-দিনের বেলা কখনো খোলা হয়না, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কেউ আসেন না। তবে রাতে ট্রেন আসার আগে ষ্টেশন কর্মকর্তা আসেন এবং কিছুক্ষণ থেকে বাসায় চলে যান। আবার ভোরে ট্রেন ছাড়ার পূর্ব মুহুর্তে এসে ট্রেন ছেড়ে দিলে পূনরায় বাসায় চলে যান।
বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে চন্দনাইশে ২০০৮ সালের ২৯ জুন প্রধান উপদেষ্টা সহ ৫ জন উপদেষ্টাদের গ্রামীণ সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। এ সংলাপে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দীন আহমদসহ ৫ উপদেষ্টার উপস্থিতিতে অনুষ্ঠানে সঞ্চালক তৎকালীন শিক্ষা ও বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমানের অনুরোধে তৎকালীন জেলা প্রশাসক দক্ষিণ চট্টগ্রামের অবস্থা সম্পর্কে তুলে ধরেন। এ সময় জেলা প্রশাসক মো. আশরাফ শামীম চট্টগ্রাম-দোহাজারী রেললাইন সম্প্রসারণ ও সংস্কারের জন্য প্রধান উপদেষ্টাসহ এ পরিষদের সকল উপদেষ্টাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। প্রধান উপদেষ্টা প্রধান অতিথির বক্তব্যে চট্টগ্রাম-দোহাজারী রেললাইনের খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিলেও তা পরবর্তীতে আর কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর চট্টগ্রাম-দোহাজারী রেললাইনকে সম্প্রসারণ করার লক্ষ্যে দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার হয়ে ঘুমধুম পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণের পরিকল্পনা হাতে নেয়। এ ব্যাপারে সরকারের নীতি নির্ধারণী একনেকের বৈঠকে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। বর্তমানে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কার্যক্রম এগিয়ে চলেছে।

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on email
Email
Share on print
Print

আজকের সর্বশেষ সংবাদ