
তসলিম খাঁ
বাংলার আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য, সুফি দর্শন এবং তরিকতপন্থী সাধনা-সংগীতের এক জীবন্ত দলিল হলো “শানে আমির অমূল্য রতন”। গ্রন্থটি মূলত চট্টগ্রামের পটিয়ায় অবস্থিত আমিরভাণ্ডার দরবার শরীফের শতবর্ষী ছেমা মাহফিলের গজল, কছিদা, জিকির ও মিলাদের সংকলন। ১৯৭১ সালে প্রকাশিত “শানে আমির” এরপর ২০১৪ সালে প্রকাশিত হয় “শুন গুরু চিত্ত সই” নামে। পরবর্তীতে বইটির নবনামকৃত ও সম্প্রসারিত সংস্করণই হলো এই “অমূল্য রতন”।
গ্রন্থের কাঠামো ও বিষয়বিন্যাস দুই পর্বে বিন্যস্ত—প্রথম পর্বে রয়েছে হযরত আমিরুল আউলিয়া শাহসুফী মাখদুম খাজা সৈয়দ আমিরুজ্জামান শাহ (ক.)-এর জীবনী, ছেমা মাহফিলের তরতীব, জিকির পদ্ধতি ও মিলাদ শরীফ। দ্বিতীয় পর্বে সংকলিত হয়েছে “কছিদায়ে আমির”, পুরনো ও নতুন আমিরভাণ্ডারী গজল, বাংলা ও উর্দু কবিতা।
পুরনো সংকলনের ২১টি গজলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন ২৪টি গজল — যার মধ্যে মরহুম নুরুল হক ফকিরের ১২টি বাংলা গজল ও মুহাম্মদ শফি হোসাইনী আমিরীর ১২টি উর্দু গজল অন্তর্ভুক্ত। তৃতীয় প্রকাশনায় আরও ৯টি নতুন গজল সংযোজিত হওয়ায় গ্রন্থটি হয়েছে আরও সমৃদ্ধ ও পূর্ণাঙ্গ।
ভাষাশৈলী গ্রন্থটিকে করেছে সরল, প্রাঞ্জল ও হৃদয়গ্রাহী। সুফি ভাবধারা, প্রেম, জিকির, ভক্তি ও আধ্যাত্মিক উপলব্ধির মিশ্রণে প্রতিটি গজল যেন এক একটি আত্মার আর্তি।
গ্রন্থটির প্রকাশক সৈয়দ মামুন রশিদ আমিরী (ম.) ৯ পাতায় নিজের নিবেদনা উল্লেখ করেছেন, “আল্লাহ, রাসুল (সা.), আহলে বাইত ও সাহাবায়ে কিরামের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে আমিরভাণ্ডার দরবারের আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকার সংরক্ষণে যে আন্তরিকতা দেখিয়েছেন, তা পাঠককে গভীরভাবে স্পর্শ করে।”
গ্রন্থটি আধ্যাত্মিক তাৎপর্য আমি এ অধম যদি উল্লেখ করি তাহলে বলা যায়, হযরত আমিরুল আউলিয়া (ক.)-এর রচনাগুলো নিছক গজল নয়; এগুলো তাসাওফ বা সুফিবাদের অন্তর্নিহিত সত্যের কাব্যিক প্রকাশ। যেমন তাঁর রচিত গজলে দেখা যায়—
“তুমি যেই আমি সেই তুমি আমি এক/ যেই পাবে জ্ঞান আঁখি সেই বুঝিবেক।”
এখানে মরমি ঐক্যের যে দর্শন প্রতিফলিত হয়েছে, তা বাংলা সুফি সাহিত্যের ধারাবাহিকতায় অনন্য। তাঁর ভক্তিমূলক কছিদা—
“হাবিবের রহমান মেরে বাবাজান/সাহেবে সুলতান আমিরুজ্জামান।”
— এখনো ভক্তমণ্ডলীর মুখে মুখে উচ্চারিত হয় আমিরভাণ্ডার দরবারের মাহফিলগুলোতে।
ঐতিহ্য ও সাহিত্যিক মূল্যে আমিরভাণ্ডার শরীফের ছেমা মাহফিল শুধু একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এটি এক আধ্যাত্মিক-সাংস্কৃতিক উৎসব, যেখানে ভক্ত-আশেকানরা গান ও জিকিরের মাধ্যমে আত্মার পরিশুদ্ধি খোঁজেন। “অমূল্য রতন” সেই শতবর্ষী ঐতিহ্যের সজীব দলিল।
গজলগুলোতে একদিকে যেমন ইসলামী ভাবধারা, রাসুলপ্রেম ও আউলিয়া-মাশায়েখদের প্রতি শ্রদ্ধা ফুটে উঠেছে, তেমনি মানবপ্রেম ও সমাজকল্যাণের বার্তাও প্রতিফলিত হয়েছে।
গ্রন্থটির সারসংক্ষেপ ও মূল্যায়নে বলতে চাই,“শানে আমির অমূল্য রতন” কেবল একটি গজলসংকলন নয়; এটি বাংলার সুফি ঐতিহ্যের এক জীবন্ত ঐতিহাসিক দলিল। এতে ধর্ম, দর্শন, সঙ্গীত ও কাব্যের সুমিলন ঘটেছে। প্রকাশক ও সম্পাদকের যত্নশীলতা এবং ভক্তদের অবদান বইটিকে করেছে গবেষণাযোগ্য ও পাঠযোগ্য।
বাংলা সুফি সাহিত্য ও দরবারি সংগীতের ধারায় “অমূল্য রতন” একটি মূল্যবান সংযোজন। সহজ ভাষা, হৃদয়গ্রাহী ভাব ও আধ্যাত্মিক গভীরতা— এই তিনের সমন্বয়ে বইটি হয়ে উঠেছে সত্যিকার অর্থে অমূল্য রতন।তাসাওফ, সুফি সংগীত, বাংলা গজল ও আধ্যাত্মিক সাহিত্যপ্রেমীদের জন্য এই গ্রন্থটি সংগ্রহযোগ্য ও পাঠযোগ্য এক অনন্য সম্পদ।
বইটি প্রকাশ করেছেন গোলামে হাসনাঈন খাদেমুস সূফিয়া শাহ মও. সৈয়দ মুহাম্মদ মামুন রশিদ আমিরী (ম.) এবং সম্পাদক ও নিরীক্ষক করেছেন ফরিদ জামী। বইটি প্রথম প্রকাশ হয় ১৪ জানুয়ারি ২০১৪ ইং, বর্তমানে বইটিতে বর্ধিত কলরবে প্রকাশ গত ১৪ জানুয়ারি ২০২৫ ইং। এটির পৃষ্ঠা সংখ্যা ১০০। মূল্য রাখা হয়েছে মাত্র ১০০ টাকা। গ্রন্থটি পাওয়া যাবে আমিরভান্ডার দরবার শরীফ, পটিয়ায় ও রেজা-এ-মোস্তফা পাবলিকেশন, আন্দরকিল্লা, চট্টগ্রামে।
লেখক: সাংবাদিক, কবি ও ছড়াকার।

















