গত সপ্তাহে পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ হারানোর তালিকায় শীর্ষ স্থানটি দখল করেছে আর্থিক খাতের কোম্পানি ইন্টারন্যাশনাল লিজিং। বিনিয়োগকারীরা কোম্পানিটির শেয়ার কিনতে আগ্রহী না হওয়ায় সপ্তাহজুড়েই দাম কমেছে। এতে কোম্পানিটির শেয়ারের দামে বড় ধরনের পতন হয়েছে।
এদিকে দাম কমে যাওয়ার পরও বিনিয়োগকারীদের একটি অংশ কোম্পানিটির শেয়ার কিনতে আগ্রহী না হওয়ায় সপ্তাহজুড়ে লেনদেন হয়েছে ৪ কোটি ৯২ লাখ ৫৭ হাজার টাকা। আর প্রতি কার্যদিবসে গড়ে লেনদেন হয়েছে ৯৮ লাখ ৫১ হাজার টাকা।
অপরদিকে শেয়ারের দাম কমেছে ১২ দশমিক ৮২ শতাংশ। টাকার অঙ্কে প্রতিটি শেয়ারের দাম কমেছে ৫০ পয়সা। সপ্তাহের শেষ কার্যদিবস শেষে কোম্পানিটির প্রতিটি শেয়ারের দাম দাঁড়িয়েছে ৩ টাকা ৪০ পয়সা, যা তার আগের সপ্তাহ শেষে ছিল ৩ টাকা ৯০ পয়সা।
শেয়ারের এমন দাম কমার পিছনে কোম্পানিটির আর্থিক দূরবস্থার প্রধান কারণ হিসেবে কাজ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পরিদর্শনে উঠে এসেছে, প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদার ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে ঋণের নামে এক হাজার ৫৯৫ কোটি টাকা বের করে নেন। তিনি এনআরবি গ্লোবাল ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের সাবেক এমডি।
এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের এমডি থাকা অবস্থায় ২০১৫ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের শেয়ার কিনে কর্তৃত্ব নেন। এরপর এসব ঋণ নেন। ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের পাশাপাশি পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ও বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানির (বিআইএফসি) নিয়ন্ত্রণ নেন তিনি। এসব পরিবর্তনে অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
গত জানুয়ারিতে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের সাত আমানতকারী টাকা ফেরত চেয়ে উচ্চ আদালতে আবেদন করেন। আবেদনের শুনানি শেষে বিচারপতি মোহাম্মদ খুরশিদ আলম সরকারের একক হাইকোর্ট বেঞ্চ গত ১৯ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদকে চেয়ারম্যান নিয়োগ দেন। গত ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দেন তিনি।
তবে সমস্যাগ্রস্ত হয়ে পড়ায় গত সপ্তাহে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে পদত্যাগ করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে গত ১ মার্চ আদালতের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন তিনি।
উচ্চ আদালতের নির্দেশে গত ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন ইব্রাহিম খালেদ। প্রতিষ্ঠানটিকে ভালো অবস্থানে নেয়ার কোনো সম্ভাবনা না থাকায় তিনি পদত্যাগ করেছেন বলে জানিয়েছেন।
পদত্যাগের কারণ হিসেবে খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বিভিন্ন গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের যে ঝামেলা, তাতে আমি স্বাস্থ্যগতভাবে বহন করার মতো অবস্থায় নেই। যে কারণে পদত্যাগ করেছি। এর আগে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি প্রধান বিচারপতির কাছে একটি প্রতিবেদন দাখিল করেছিলাম।
‘সেখানে বলেছি, ২০১৫ সাল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি ভালো চলছিল। তখন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহবুব জামিল এর চেয়ারম্যান ছিলেন। পি কে হালদার ও তার গ্রুপ আচমকা তাকে সরিয়ে দিয়ে পর্ষদ পুনর্গঠন এবং ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে কোণঠাসা করে অনেক টাকা বের করে নিয়েছে।’
তিনি বলেন, পি কে হালদার অনেক টাকা পাচার করে নিজেও বাইরে চলে গেছেন বলে শুনেছি। যে প্রতিষ্ঠানের টাকা পাচার হয়ে গেছে, তা উদ্ধার করা তো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এটা দেখবে দুদক। আর প্রতিষ্ঠান রক্ষায় কাজ করবে বাংলাদেশ ব্যাংক।
ইব্রাহিম খালেদ আরও বলেন, মাহবুব জামিলের মতো নামকরা লোককে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে সরিয়ে পি কে হালদাররা দলেবলে ঢুকল এবং সব পরিবর্তন করে ফেলল। বাংলাদেশ ব্যাংকের নজর এড়িয়ে এসব সম্ভব হয়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে জনগণের আমানত রক্ষা করার দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের। এ ক্ষেত্রে তাদের দুর্বলতা দেখা গেছে।
এ ছাড়া ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের ঘটনার চার বছর পরও বাংলাদেশ ব্যাংক কেন কোনো ব্যবস্থা নিল না, সেটা দেখতে হবে। তিনি বলেন, নাগরিক হিসেবে আদালতের প্রতি সম্মান দেখিয়ে আমি দায়িত্ব নিয়েছিলাম। তবে এই প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করা সম্ভব নয়- যোগ করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এই ডেপুটি গভর্নর।
কোম্পানিটির এসব তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ায় গত সপ্তাহজুড়েই শেয়ারের দরপতন হয়। ২২১ কোটি ৮১ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধনের কোম্পানিটির মোট শেয়ারের সংখ্যা ২২ কোটি ১৮ লাখ ১০ হাজার ২৪৭টি। এর মধ্যে ৪১ দশমিক ৫৪ শতাংশ আছে উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের হাতে। বাকি শেয়ারের মধ্যে ৩১ দশমিক ৬১ শতাংশ সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে আছে। আর ২৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী এবং দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ বিদেশিদের কাছে আছে।
ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের পরেই গত সপ্তাহে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ হারানোর তালিকায় ছিল সিটি জেনারেল ইন্স্যুরেন্স। সপ্তাহজুড়ে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম কমেছে ১২ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। এরপরই রয়েছে রংপুর ডেইরি। সপ্তাহজুড়ে এই কোম্পানিটির শেয়ার দাম কমেছে ১১ দশমিক ৭৩ শতাংশ।
এছাড়া গত সপ্তাহে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ হারানোর শীর্ষ ১০ প্রতিষ্ঠানের তালিকায় থাকা- রানার অটোমোবাইলের ১০ দশমিক ৩৮ শতাংশ, আমান ফিডের ১০ শতাংশ, ইমারেল্ড অয়েলের ৯ দশমিক ৭০ শতাংশ, আফতাব অটোমোবাইলের ৯ দশমিক ৫১ শতাংশ, ফাস ফাইন্যান্সের ৯ দশমিক ৩০ শতাংশ, এমএল ডাইংয়ের ৯ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ এবং সামিট অ্যালায়েন্স পোর্টের ৮ দশমিক ৫৩ শতাংশ দাম কমেছে।