দেশচিন্তা ডেস্ক: সিসিআরএসবিডি’র আঞ্চলিক সংলাপে বক্তারা বলেছেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি, সম্প্রীতি ও নিরাপত্তা জোরদারে রাজনৈতিক দলগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে এবং সমস্যা সমাধানে এটা নির্বাচনি অঙ্গীকার হওয়া উচিৎ। ১৯৯৭ সালে শান্তি চুক্তি হলেও তা কার্যত অচল। তাই সমস্যা সমাধান ও রক্তপাত মুক্ত পার্বত্য অঞ্চল গড়তে পাহাড় সমতল ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ী শান্তি, সম্প্রীতি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কেবল একটি আঞ্চলিক অগ্রাধিকার নয়, বরং একটি জাতীয় অপরিহার্যতা। রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনী বক্তব্যের সীমা অতিক্রম করে বুদ্ধিবৃত্তিক স্বচ্ছতা, কৌশলগত দূরদৃষ্টি এবং নীতিনির্ভর চিন্তার পরিচয় দিতে হবে। নির্বাচনী ইশতেহারে স্পষ্ট ও স্বচ্ছ অবস্থান উপস্থাপন এবং কাঠামোবদ্ধ নীতিগত রূপরেখা গ্রহণের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলো জাতীয় ঐক্য সুদৃঢ়করণ, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ এবং অঞ্চলে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
২১ ডিসেম্বর, রবিবার সকাল ১১টায় চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওন্যাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ(সিসিআরএসবিডি) উদ্যোগে সাউদার্ন ইউনিভার্সিটির স্থায়ী ক্যাম্পাস বায়েজিদ আরেফিন নগরে হল রুমে অনুষ্ঠিত পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি, সম্প্রীতি ও নিরাপত্তা জোরদারে রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনি অঙ্গীকার বিষয়ক আঞ্চলিক সংলাপে বক্তারা এসব কথা বলেন।
সিসিআরএসবিডি'র চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী চৌধুরীর সভাপতিত্ব আয়োজিত আঞ্চলিক সংলাপে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি ও সিসিআরএসবিডি'র নিবার্হী পরিচালক অধ্যাপক ড. মাহফুজ পারভেজ। সিসিআরএসবিডি'ও পরিচালক অধ্যাপক সরওয়ার জাহানের সঞ্চালনায় সংলাপে প্যানেল আলোচক ছিলেন চবির সমাজ বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো. এনায়েত উল্যা পাটওয়ারী, সিনিয়র সাংবাদিক ওমর কায়সার, বীর মুক্তিযোদ্ধা মং রাজা মং প্রম্ন সাইন ফাউন্ডেশন এর চেয়ারম্যান কুমার সুই চিং প্রম্ন সাইন। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন পরিচালক, চাকসু কেন্দ্র, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাহেদুর রহমান চৌধুরী এবং সংলাপের সারসংক্ষেপ তুলে ধরেন চবির আইকিউএসির পরিচালক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মোশারেফ হোসেন। এছাড়াও বক্তব্য রাখেন উপাচার্য(ভারপ্রাপ্ত) ড. শরীফ আশাফউজ্জামান, বান্দরবান বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল(অব.) শাহ মোহাম্মদ সুলতান উদ্দিন ইকবাল বীর প্রতীক ।
মূল প্রবন্ধে অধ্যাপক ড. মাহফুজ পারভেজ বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম (সিএইচটি) বাংলাদেশের সবচেয়ে সংবেদনশীল এবং কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলগুলির মধ্যে একটি, জাতিগত বৈচিত্র্য, ঐতিহাসিক অভিযোগ এবং মাঝে মাঝে নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ দ্বারা চিহ্নিত। জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি, সম্প্রীতি ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত তাদের দৃষ্টিভঙ্গি, নীতি নির্দেশনা এবং কৌশলগত প্রতিশ্রুতি প্রকাশ করা সকল রাজনৈতিক দলের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি সত্ত্বেও, বেশ কিছু অমীমাংসিত সমস্যা—প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ, ভূমি বিরোধ, নিরাপত্তা উদ্বেগ এবং আন্তঃ—সম্প্রদায়িক আস্থার ঘাটতি টেকসই শান্তিকে বাধাগ্রস্ত করে চলেছে। নির্বাচনী ইশতেহারগুলি প্রায়শই এই বিষয়ে নীরব বা অস্পষ্ট থাকে। এই নীতি নোটটি যুক্তি দেয় যে রাজনৈতিক দলগুলিকে এই অঞ্চলের প্রতি তাদের ভূমিকা এবং দায়িত্ব সংজ্ঞায়িত করার জন্য আরও স্বচ্ছ, বুদ্ধিবৃত্তিক এবং নীতি—চালিত পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে।
তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ী শান্তি, সম্প্রীতি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পটভূমি, সমস্যা বিবৃতি, নীতির উদ্দেশ্য, রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে প্রত্যাশিত প্রতিশ্রুতি, নীতি এবং কৌশলের জন্য গাইডিং নীতি সহ বিভিন্ন সুপারিশমালা তুলে ধরেন। এছাড়াও তিনি নিন্মোক্ত ১৫টি সুপারিশ উপস্থাপন করেন।
১. শান্তিচুক্তির স্পর্শকাতর ও পরস্পরবিরোধী ধারা খ—২৪ এবং ঘ—১৭ ধারা পুনর্মূল্যায়ন করে নিরাপ নিশ্চিতের জন্য সেনাক্যাম্প বহাল রাখা এবং ও পুলিশের নিয়োগে পাহাড়ি—বাঙালি সমতায়ন।
২. ভূমি কমিশন আইন সংশোধন করে সিদ্ধান্ত গ্রহণে চেয়ারম্যানের একক ক্ষমতার স্থলে কমিশনের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সিদ্ধান্ত প্রতিস্থাপন পূর্বক গণতন্ত্রায়ন করা।
ও ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির আগে সঠিক জরিপের মাধ্যমে সরকারি খাস, বসবাসকারী বাঙালি ও পাহাড়িদের জমি শনাক্তকরণের কাজ সম্পন্ন করা।
৪ আঞ্চলিক ও জেলা পরিষদসমূহের নির্বাচন ৫ বছর পর পর করার আইন থাকলেও তা অদ্যাবধি বাস্তবায়িত হয় নি বিধান নির্বাচনের মাধ্যমে জনমতের ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করা।
৫. বাঙালি ও পাহাড়ি উভয় গোষ্ঠীর আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু সঠিক তথ্যের ভিত্তিতে চিহ্নিত করা।
৬ বৈষম্য দূরীকরণে ও পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে চাকরি ও উচ্চশিক্ষায় কোটা বৈষম্য ট্যাক্স বৈষমা ব্যবসা ও লাইসেন্স ফি বৈষমা জমিক্রয় বৈষম্য দূর করা।
৭. সন্ত্রাস, অপহরণ, চাঁদাবাজি, অস্ত্র—মানব—মাদক পাচারে নিয়োজিত সন্ত্রাসী গোষ্ঠীসমূহের বিরুদ্ধে সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিরোধ গড়তে সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করা।
৮. সংখ্যা—সাম্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন পদ বণ্টন ও উন্নয়ন বরাদ্দের ক্ষেত্রে সামঞ্জস্য বিধান করা।
৯ দেশি—বিদেশি প্ররোচণায় বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম প্রতিরোধের জন্য রাজনৈতিক সামাজিক ও প্রশাসনিক বাবস্থা করা।
১০ গোষ্ঠীবাদী—বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজনৈতিক মনোভাব ত্যাগ করে সকল রাজনৈতিক দল ও নেতৃবৃন্দের পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি, সম্প্রীতি ও নিরাপত্তা জোরদারে সুস্পষ্ট নির্বাচনি অঙ্গীকার প্রকাশ ও তা বাস্তবায়ন করার দৃশ্যমান পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
১১ সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও গোষ্ঠীগত উত্তেজনা প্রশমনে দল ও নেতৃবৃন্দকে রাজনৈতিক উদ্যোগ সংলাপ, আলাপ—আলোচনার মাধ্যমে সক্রিয় হওয়া।
১২. পার্বত্য চট্টগ্রামের নানামুখী সমস্যাকে সামরিক দিকে ঠেলে দেওয়ার প্রবণতা ত্যাগ করে দল ও নেতৃত্বকে রাজনৈতিক সমাধানের জন্য আন্তরিকতা ও দক্ষমতার সঙ্গে সকল সংস্থা ও সকল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করা।
১৩. শান্তি, সম্প্রীতি ও উন্নয়নের প্রতি বিরোধিতামূলক মনোভাবাপন্ন দল ও নেতাদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ বন্ধ করার জন্য স্থানীয় প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করা।
১৪ সীমান্তে অনুপ্রবেশ ও নাশকতা রোধে নজরদারি বাড়ানোর ক্ষেত্রে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে তথ্য আদান—প্রদান ও সমন্বয় করার মাধ্যমে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা।
১৫. আর্থিক উন্নতি, মানবসম্পদ বিকাশ, দক্ষতামূলক প্রশিক্ষণ, পর্যটন, হোটেল ম্যানেজমেন্ট খাতকে এগিয়ে নিতে দল ও নেতাদের পক্ষে বিদ্বেষী মনোভাব ত্যাগ করে সহযোগিতামূলক অবস্থান।
সম্পাদক ও প্রকাশক: মুহাম্মদ ইমরান সোহেল। মোবাইল : ০১৮১৫-৫৬৩৭৯৪ । কার্যালয়: ৪০ কদম মোবারক মার্কেট, মোমিন রোড, চট্টগ্রাম। ইমেল: [email protected]
Copyright © 2025 Desh Chinta. All rights reserved.